তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়ে কী বলা হলো
বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করে রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা দুটি পৃথক সিভিল আপিল মঞ্জুর ও চারটি রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে সর্বসম্মত হয়ে আজ বৃহস্পতিবার এই রায় দেন। তবে এটি কার্যকর হবে আগামী চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।
সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, গত ১৪ বছর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পুরো রায়কে ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত উল্লেখ করে তা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হলো। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে আগামী চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে। তবে আপিল বিভাগের রায় পূর্ণাঙ্গ প্রকাশের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
আপিল বিভাগের অপর ছয় সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবেন। গণতন্ত্র রক্ষা হবে। আমরা সংঘাতের রাজনীতি থেকে মুক্ত হলাম।’ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরেছে, তবে এর গঠন আগের নাকি জুলাই সনদের বর্ণিত কাঠামো অনুযায়ী হবে, তা পরবর্তী সংসদ নির্ধারণ করবে।’
এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। ফলে তখনই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফেরার পথ তৈরি হয়। এবার ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল হলো।
রায়ে কী বলেন আদালত
রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়টি ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এর নির্দলীয় সরকার–সম্পর্কিত বিধানাবলি, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের ৩ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। তবে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ (১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮গ (২)-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানাবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে। সংক্ষিপ্ত আদেশে আরও উল্লেখ করা হয়, যে পরবর্তীতে আদালত বিস্তারিত রায় বা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করবেন।
সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আপিল ও সিভিল রিভিউসমূহ সর্বসম্মতভাবে মঞ্জুর করা হলো। সেই সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের রায়কে ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত উল্লেখ করে তা সম্পূর্ণ বাতিল করা হল।
আদালতে রিটকারীর পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ছিলেন মোহামদ শিশির মনির। এছাড়া ইন্টারভেনর হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, আইনজীবী মহসীন রশিদ, ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।
রায়ের প্রেক্ষাপট
বিএনপি সরকারের সময়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ওই রিট খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে। এর বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারী পক্ষ ২০০৫ সালে আপিল দাখিল করেন।
২০১১ সালের ১০ মে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। পরবর্তীতে প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত আদেশের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধানসমূহ বাদ দেওয়া হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।
গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন, বিএনপি-জামায়াতসহ একাধিক রাজনৈতিক দল ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন দাখিল করেন। পাশাপাশি নওগাঁর রাণীনগরের নারায়ণপাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও গত বছর একটি রিভিউ আবেদন করেন।
এ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট আপিলের অনুমতি দেন। পরবর্তীতে ১০ কার্যদিবস এ আপিলের ওপর বিস্তারিত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বেঞ্চ গত ১১ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় সংক্ষিপ্ত রায় দেন।


