যে আঞ্চলিক মহাসড়ক বদলে দিয়েছে ভোলাবাসীর যোগাযোগ মাধ্যম!
চারদিকে নদীর উত্তাল জলরাশি আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা বেষ্টিত ধান, সুপারি, ইলিশ আর জিআই পণ্যে স্বীকৃত মহিষের দধি আর প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দ্বীপ জনপদের জেলা ভোলা। ৩ হাজার ৪০৩ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলা সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। ছোট ছোট দ্বীপ, সবুজ অরণ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শোভিত চরাঞ্চল সমৃদ্ধ এ অঞ্চল ভ্রমণ আর আনন্দ কুড়াবার প্রাচুর্য এ জেলা এখন পর্যটন শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনাময়। এখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ২২ লক্ষাধিক। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন আর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বসবাস করে জীবন কাটে এখানকার বাসিন্দাদের।
১৯৭০ সালের ভয়াল সেই ১২ ই নভেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়টি (সাইক্লোন) যেই জনপদে আঘাত হেনেছিল, সেই দানবাকৃতির তুফানের আঘাতে যেখানে মৃত্যুর মিছিলের সারিতে ছিল লক্ষাধিক মানুষ, সেই ভূমির নামই হচ্ছে-দ্বীপ জনপদের ভোলা। দেশের অন্যসব জেলাগুলোর চাইতে এজেলা ছিলো একেবারেই অনুন্নত ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিদারুণ এক ভঙ্গুর জনপদ।
একসময়কার মহকুমা শহর থেকে ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত হওয়া এই ভূমিতে কখনো লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। গড়ে ওঠেনি আধুনিকতা, আর ঘটেনি সভ্যতার বিকাশ। দক্ষ অভিভাবক ও ডাকসাইডে জনপ্রতিনিধির অভাবে দুর্গম এই দূর জনপদের মানুষের দুর্ভোগ আর সীমাহীন দুর্যোগে আর্তচিৎকারের শব্দ যেতো না উপর মহলের কর্তাবাবুদের কানে।
কালের বিবর্তনে এরশাদ সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মরহুম নাজিউর রহমান মঞ্জু’র হস্তক্ষেপে এখানে শুরু হয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। বিশেষ করে জেলা সদর ভোলার সাথে এক সড়কেই চরফ্যাশন পর্যন্ত ৭ উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা এবং ৭৮ টি ইউনিয়নের সাথে সংযোগ বিদ্যমান। কিন্তু ওই সময়টিতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল একেবারেই খানাখন্দে ভরা এক চরম দুর্ভোগময় অবস্থা। জেলার প্রতিটি উপজেলায় মানুষের চলাচলে সড়ক ব্যবস্থা ছিলো একেবারেই নাজুক। অবশেষে ওই সময়ের মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জু তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভোলা টু চরফ্যাশন উপজেলার কচ্ছপিয়া এলাকা পর্যন্ত দেড়শ' কিলোমিটার সড়কটিকে আঞ্চলিক মহাসড়কে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর চলমান প্রকল্পের তালিকার সাথে একীভূত করেন।
সরকারের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হেভিওয়েট সড়ক নির্মাণ প্রকল্পগুলোর তালিকায় ভোলার এ সড়কটি অন্তর্ভুক্ত থাকায় সব সরকারের আমলেই ভোলার আঞ্চলিক মহাসড়ক সংস্কার ও নতুন হাইওয়ে সড়ক নির্মাণের বরাদ্দ অনুমোদন হয়ে থাকে। একসময়কার পরিত্যক্ত ও চলাচলের অনুপযোগী এ সড়কটি কালক্রমে এখন মহাসড়কে রূপান্তরিত হওয়ায় এখানকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক আমূল বিপ্লব ঘটেছে। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলার সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থায় এজেলার ২২ লাখ মানুষের ভাগ্যবদল হয়ে পাল্টে গেছে জেলার দৃশ্যপট।
ভোলার বাস মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম খান বলেন, "এই আঞ্চলিক মহাসড়ক আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই মহাসড়কটিতে প্রচুর থ্রি হুইলার যান চলাচল করছে। যা মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে একেবারেই নিষিদ্ধ। ভোলার প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই নীরব। এগুলো চলার স্পিড লিমিট আছে, তারা তা মানছে না। এই আঞ্চলিক মহাসড়কটিতে নিয়মিত বাস চলাচল করছে, অপর দিকে সড়কটিতে অহরহর থ্রি হুইলার যান চলাচল করছে। যার কারণে এই সড়কটি এখন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। অতি দ্রুত এই থ্রি হুইলার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। "
ভোলা ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুনতাসির আলম রবিন চৌধুরী বলেন, "এই আঞ্চলিক মহাসড়কটি হওয়ার কারণে ভোলার যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি চিকিৎসা খাতেও একটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ভোলার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা গুলো থেকে গুরুতর অসুস্থ কোন রোগীকে জরুরী চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ভোলায় অস্থির ৬ থেকে ৭ ঘন্টা লেগে যেত। এই সময়ের মধ্যে এক চততাংশ রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যেত। আঞ্চলিক মহাসড়কটি হওয়ার কারণে এখন এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভোলা এনে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে রোগী মৃত্যুর হার কমেছে ৯০ শতাংশ।"
ডিজেল ও পেট্রোল ব্যবসায়ী জুয়েল বলেন, "ভোলায় আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণের ফলে আমরা জেলাব্যাপী খুব দ্রুততম সময়েই তেল, ডিজেল, পেট্রোল পাইকারদের কাছে সরবরাহ করতে পারি। মানসম্মত হাইওয়ে সড়কের ফলে লাখ লাখ মানুষের চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। "
মেঘনা যুব ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান দাউদ ইব্রাহিম সোহেল বলেন, "জেলায় সড়ক যোগাযোগে আমূল পরিবর্তনের ফলে চরফ্যাশনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কুকরী-মুকরীতে বহু টাকা পুঁজি খাটিয়ে রিসোর্ট, বিনোদন কেন্দ্র ও রেস্টুরেন্ট করছে ব্যবসায়ীরা। " তিনি বলেন, "বহু উদ্যোক্তাগণ সেখানে বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবসা দিয়ে লাভবান হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের আগমনের ফলে এ জেলায় আরো ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। "
জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, "এ সড়কটিতে চারটি সরু বেইলি ব্রিজ ছিল। সেগুলো ভেঙে ইতোমধ্যেই পিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো বাঙালি ব্রিজ, বোরহানউদ্দিন ব্রিজ, ঢাওরী ব্রিজ ও শশীভূষণ ব্রিজ। পূর্বে বেইলি ব্রিজ দিয়ে দু’টি ট্রাক বা বাস পাশাপাশি যেতে পারতো না, একটি সেতুতে উঠলে অন্যটি অপেক্ষা করত। তিনি বলেন, পূর্বের সেতুতে ধারণ ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫ থেকে ৭ টন। আর বর্তমানে নির্মিত সেতুগুলোতে অনায়াসেই ৩০ টন বহন করা যায়। এছাড়া এই সড়কে মোট ৪১টি কালভার্টের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরইমধ্যে উপকূলের আঞ্চলিক সড়কপথকে আধুনিকীকরণে বাস্তবসম্মত বহু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। "
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বাসসকে বলেন, "একসময় চরম অনুন্নত ভোলা এখন উন্নয়নে উৎসবে সমৃদ্ধ একটি সম্ভাবনার জেলা। এখানে শুধু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নতি হয়নি, প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শোভিত পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনায় আমরা আধুনিক উন্নয়নধারায় এক ভিন্নরকম অগ্রগতির দিকে যাচ্ছি। ফলে আগামীতে আমরা শ্রেষ্ঠ জেলা হিসেবে ভোলাকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার। "


