‘ঘুষ খাইনি, দাওয়াত খেয়েছি’
যশোর জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী আলমগীর হোসেন দাবি করলেন, ‘তিনি ঘুষ খাননি; দাওয়াত খেয়েছেন, আর পাকা কলা খেয়েছেন।’ দোকান বরাদ্দের নামে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিলেন দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। গতকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে যশোরে গণশুনানিকালে তিনি এই আদেশ দেন। শুধু জেলা পরিষদ নয়, যশোরের ৩৭টি দপ্তরের ৭৫টি অভিযোগের শুনানি করেন তিনি। যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের এই শুনানিকালে উপস্থিত ছিলেন কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী।
গতকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) সকাল ১০টায় এই শুনানি শুরু হয়ে একটানা বিকেল ৪টি পর্যন্ত চলে।
গতকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) সকালে গণশুনানির উদ্বোধনকালে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন রসিকতা করে বলেন, ‘খবরে দেখলাম দুদক চেয়ারম্যানের চেয়ারের দাম দুশ কোটি টাকা। আগে শুনতাম চেয়ারের দাম পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তাহলে ৪৮শ’ কোটি টাকা তো কমেছে!
এরপর দুদক চেয়ারম্যান বলেন, "দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গণশুনানি মানে কর্মকর্তাদের সাথে জনগণকে মুখোমুখি করে দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে কর্মকর্তাদের জনগণের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে যাতে সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। "
তিনি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, "এই জেলা থেকে যখন বদলি হয়ে যাবেন, তখন যদি আপনার জন্য মানুষের চোখের কোনে পানি জমা হয়, তাহলে বুঝবেন কাজ করেছেন। যদি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন তাহলে অন্তত বিবেকের কাছে কিন্তু জবাবদিহিতা করতে হবে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছেও জবাবদিহিতা করতে হবে। এই গণশুনানি থেকে যদি সেবাদাতা ও সেবাগ্রহিতা যদি হাসিমুখে যেতে পারি তাহলেই এই উদ্যোগ সফল হবে। "
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বলেন, মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দুদক নানা প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এজন্য কোনোভাবেই অনিয়ম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বক্তব্য দেন, দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন ও যশোরের পুলিশ সুপার রওনক জাহান। স্বাগত বক্তব্য দেন দুদক খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জালাল উদ্দিন আহমেদ।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলামের সঞ্চালনায় গণশুনানি শুরু হয়। শুনানিতে ৩৭টি দপ্তরের ৭৫টি অভিযোগের শুনানি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ও কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে বিভিন্ন ধরণের আইনগত নির্দেশনা দেন।এর মধ্যে, যশোর জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী আলমগীর হোসেনকে ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগে সমায়িক বরখাস্ত করে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন।
বিআরটিএ অফিস এলাকায় দালালের আধিপত্যের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক চেয়ারম্যান বিআরটিএ যশোরের সহকারী পরিচালক এএসএম ওয়াজেদ হোসেনকে প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে দালাল নির্মূলের নির্দেশ দেন এবং আলোচিত দালাল সোহেলকে আটকের জন্য পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ও খাবারের মানোন্নয়নের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি হাসপাতালেও দালাল উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। হাসপাতালের কর্মচারী পবিত্র বিশ্বাস এক শিশুর কানের চিকিৎসা করতে গিয়ে তার কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে কর্মচারীর বিরুদ্ধে গৃহিত ব্যবস্থা সন্তোষজনক না হওয়ায় চেয়ারম্যান উষ্মা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা দূর ও রাতে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মো. হুসাইন শাফায়াতকে নির্দেশ দেন।
এ সময় তত্ত্ববধায়কও ২৫০ শয্যা বিপরীতে চারগুণ রোগীর চাপের কারণে সেবা প্রদানে সীমাবদ্ধতার কথা জানান। হাসপাতালগুলোর খাদ্য সরবরাহ নিয়ে মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিরসন করার জন্য দুদকও ভূমিকা রাখবে বলে গণশুনানি থেকে জানানো হয়।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের দু’টি সড়কের উন্নয়নকাজ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় চেয়ারম্যান দুদক যশোর কার্যালয়কে তদন্তের নির্দেশ দেন।
ভৈরব নদ ও মুক্তেশ্বরী নদী দখল দূষণের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপতি হলে শুনানি থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, পৌরসভা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যৌথ কমিটি করে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
যশোরের ফতেপুর ইউনিয়নের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সালমা খাতুন ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে তিন লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনেন আরজিনা খাতুন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক চেয়ারম্যান সিভিল সার্জন ডা. মাসুদ রানাকে এই অভিযোগটি থানায় প্রদান করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। একইসাথে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নাজনীন সুলতানার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে ঘুষ গ্রহণ ও হুমকি প্রদানের অভিযোগ থাকায় তাকে বদলিসহ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ওমর ফারুকের নিয়োগসহ বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় চেয়ারম্যান দুদক যশোর কার্যালয়কে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন।
অগ্রণী ব্যাংক যশোর শাখার নয়জন গ্রাহকের প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে পিয়ন জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, পিয়ন জসিম উদ্দিন ভুয়া পাসবইয়ে জমা দেখিয়ে তাদের এই টাকা আত্মসাত করেছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এর সাথে জড়িত।
এ সময় অভিযোগের বিপক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন অগ্রণী ব্যাংকের ডিজিএম রোকনউদ্দিন, শাখা ব্যবস্থাপক মেহেদি হাসান ও ব্যাংক কর্মকর্তঅ মিলিনা আক্তার। দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ও কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাষায় বলেন, "এতোগুলো গ্রাহকের টাকা এভাবে আত্মসাত হবে, আপনারা জানবেন না, এটা হতে পারে না। বরং গ্রাহকদের টাকা ফেরত ও পিয়ন জসিমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে গাফিলতি রয়েছে।
এ সময় চেয়ারম্যান জসিমের পেনশন ও সম্পদ থেকে টাকা নিয়ে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। অন্যথায় দুদক এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। "
এছাড়াও শিক্ষা অফিস, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌরসভাসহ বিভিন্ন সরকারি আধাসরকারি, সায়ত্বশাসিত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অভিযোগ শুনানি করে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ও কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বিভিন্ন নির্দেশ প্রদান করেন।


