অসুখী দাম্পত্য টিকিয়ে রাখবেন, নাকি বিচ্ছেদে যাবেন

মুনির-শামার বিয়ে পারিবারিকভাবে হয়েছিল। ছয় মাস না পেরোতেই শামা বুঝতে পারছিলেন, দুজনের ঠিক মিল হচ্ছে না। মতের অমিল, চিন্তাভাবনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য আর দুই পরিবারের সংস্কৃতিতেও ফারাক—সব মিলিয়ে কিছুতেই দুজনের দিন ভালো যাচ্ছিল না। তবু ভাইদের সংসারে ফিরতে চাননি বলে আরও কিছুদিন সময় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ভেবেছিলেন, সময়ের সঙ্গে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। নতুন সংসারে, নতুন পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার সব চেষ্টা তাঁর পক্ষ থেকে ছিল। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশায় গর্ভধারণও করেন।
কিন্তু মানসিক চাপ, অব্যাহত যন্ত্রণায় একপর্যায়ে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। এ ঘটনার পর সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। শেষমেশ ভাইদের বাড়িতেই ফিরে যান শামা। এই বিয়ে, সংসার, গর্ভপাত, মানসিক যন্ত্রণা তাঁর ওপর এমন প্রভাব ফেলে যে নিয়মিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন তিনি।
অফিসে কাজের ফাঁকে শামা বললেন, ‘শুরুতেই যদি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম, তাহলে আমার মন বা শরীরের ওপর দিয়ে এত ধকল যেত না। আরও আগেই ক্যারিয়ার শুরু করতে পারতাম। নিজেকে আরও ভালোভাবে গুছিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু সমাজ বা পরিবারের কথা ভেবে বারবারই পিছিয়ে এসেছি, যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’
বিয়ে কেবল দুটি মানুষের বন্ধন নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দুটি পরিবার, সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের দেশগুলোয় এখনো বিচ্ছেদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখা হয়। তাই হাজারো অমিল, অসম্মান, প্রতারণা কিংবা ঝগড়ার পরও এখানে দম্পতিরা বৈবাহিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। সেই বিয়েতে যদি বিন্দু পরিমাণও ভালোবাসা বা শান্তি না থাকে, তাতেও তাঁরা বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে চান না। কখনো তার কারণ সমাজ, কখনোবা সন্তান।
একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান তাসনিয়া ফারাজ। প্রেমের পর পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পরপরই সন্তানের মা হন। যদিও শুরু থেকেই নানান কারণে স্বামী শামসের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। কিন্তু নিজের পছন্দে এত ধুমধাম করে বিয়ের পর প্রেমিকের সঙ্গে মিলছে না, কথাটা কিছুতেই বাবা-মায়ের কাছে বলতে পারছিলেন না। আপাতদৃষ্টে সুখী পরিবার মনে হলেও তাঁরা দুজনেই বুঝছিলেন যে তাল কেটে গেছে।
এরই মধ্যে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশ যান শামস। দুজনের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে বিদেশ থেকেই বিচ্ছেদের চিঠি পাঠান শামস। মুখোমুখি বসে শেষবারের মতো কথা বলেও সংকট সমাধানের আর চেষ্টা করেননি তিনি। আইনজীবীর মাধ্যমেই সন্তানের ভরণপোষণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
শামস বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কোনোভাবেই ওর সঙ্গে মিলছিল না। আমি ভেবেছিলাম দূরে গেলে হয়তো সংকট কিছুটা কমবে। কিন্তু আমি তো পড়তে এসেছি। পড়ায় যদি মনোসংযোগই করতে না পারি, যদি চাকরি করতেই না পারি; তাহলে কী লাভ? সন্তানের জন্য হলেও তো আমাকে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। আমার মানসিক অবস্থা দেখে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার বারবার আমার সঙ্গে বসেছেন। কাউন্সেলরের সঙ্গে মিটিং করিয়ে দিয়েছেন, কয়েক দিন থেরাপিও নিয়েছি। নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধের পর বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
সবকিছু চুকেবুকে যাওয়ার পর এখন কেমন কাটছে, জানতে চাইলে শামস বলেন, ‘এখন আমি ভালো আছি। যতটুকু জানি, তাসনিয়াও ভালো আছে, নতুন জীবন শুরু করেছে। আমাদের সন্তান ওর কাছে থাকে, আমার মায়ের কাছেও থাকে। আমি দেশে গেলে সন্তানকে সময় দিই। ওর সমস্ত প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করি। এখন আমি আর তাসনিয়া মিলে মিউচ্যুয়াল প্যারেন্টিং করছি। দিন শেষে ভালো থাকাটাই তো আসল, তাই না?’
যে দুই দম্পতির কথা বললাম, তাঁরা প্রত্যেকেই বিচ্ছেদ এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। জোর করে হলেও সংসার করতে চেয়েছেন। ফলাফল হিসেবে মানসিক সমস্যা, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া, অসুস্থতা, একে অন্যকে অসম্মান করার মতো বিষয়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন। কিন্তু দিন শেষে চরম সিদ্ধান্তটা কিন্তু ঠিকই নিতে হয়েছে। মাঝখান থেকে বিচ্ছেদ ঠেকিয়ে রাখতে গিয়ে দুর্দশাই কেবল বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিয়ে, সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ নিয়ে পরামর্শ দেওয়া ওয়েবসাইট ম্যারেজ ডটকমের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, একটি খারাপ বৈবাহিক সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের অসুখী জীবন যাপন করলে একটা সময় গিয়ে নিজের আত্মমূল্যবোধ কমে যায়। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতা নষ্ট হয়। সঙ্গীর সঙ্গে ঘন ঘন দ্বন্দ্ব ও ঘনিষ্ঠতার অভাব ব্যাহত করে মানসিক সংযোগ।
অসুখী দাম্পত্য মনের পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাধাগ্রস্ত হয় ব্যক্তিগত বিকাশ। সংসারে কোনো সন্তান থাকলে তারও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অসুখী বাবা-মায়ের কারণে শিশুও বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ পায় না। সব মিলিয়ে গোটা পরিবারটিই একটি অশান্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়, যা তাঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করে।
তারপরও বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেকোনো মানুষের জন্য কঠিন। কিন্তু একটি অসুখী বৈবাহিক সম্পর্কে থেকে নির্যাতন, নিপীড়ন, মানসিক যন্ত্রণা, অসম্মান বয়ে নেওয়ার চেয়ে বিচ্ছেদ ভালো। এমনটাই মনে করেন মনোবিদেরা। এমনকি সন্তানদের মানসিক গঠন ও স্বস্তির জন্যও বিষাক্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেয়ে বিচ্ছেদ ভালো। বিচ্ছেদের পর বরং মিউচুয়াল প্যারেন্টিং করা গেলে তা সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক।
কাউন্সেলর ও রিলেশনশিপ কোচ ক্রিস্টিনা জোকু ভালো থাকার ওপর জোর দেন বেশি। তিনি বলেন, ‘অসুখী দাম্পত্য দুজনের মানসিক সুস্থতার জন্যই নেতিবাচক। সে হিসাবে বিচ্ছেদের মাধ্যমে ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে মানসিক সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।’
কোনো সম্পর্কই বিচ্ছেদ হবে বলে শুরু হয় না। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি বা বাস্তবতার কাছে অনেক সময় হার মানতে হয়। অনেক সময় পেশাগত জীবনেও প্রভাব ফেলে অসুখী দাম্পত্য। সে ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের পর প্রত্যেকে নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিতে পারে এবং জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
