সংস্কার শিক্ষার মূলধারা বেগবান ও শক্তিশালী করতে হবে
বাংলাদেশে শিক্ষা আজ যেমন ও যতটা রাজনৈতিক দলের অধীনে চলে গেছে, আগে কখনও তেমনটা দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দল বলতে এ ক্ষেত্রে সরকারি দলকেই বোঝায়। অতএব, বলা হতে পারে, এখন কোনো সরকারি দল নেই।
কিন্তু এখনও যে ক্ষমতাবান দল দুটোই ভাগ করে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং হস্তক্ষেপ করে চলেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়ন্ত্রণ গত বছর সরকার বদলের পর নিছক হাতবদল হয়েছে মাত্র। আগে স্থানীয় এমপি কিংবা তার সুপারিশের কোনো ব্যক্তি চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখন আছেন বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতারা বা তাদের মনোনীত ব্যক্তি। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তারা চেয়ারম্যান হয়েছেন। তারাও ওই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের হয়েই কাজ করছেন।
হেডমাস্টার ও প্রিন্সিপালকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া এবং তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের জঘন্য ঘটনাও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখলাম। ব্যাপারটা আরও বেশি স্পষ্ট উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ শীর্ষ প্রশাসনিক পদগুলো ওই দল দুটোর মধ্যে কীভাবে ভাগাভাগি হয়েছে; সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাই জানিয়েছেন। সরকার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে তুমুলভাবে দলীয় রাজনৈতিক তৎপরতা আগের মতোই চলছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে আরেক ব্যাধি– বাণিজ্য। বাংলাদেশে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে চিকিৎসা, বিচার, নিরাপত্তা– সবকিছুই ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হয়েছে। বিদ্যাও তাই। ক্লাসরুমে শিক্ষাদান সংকুচিত ও দুর্বল হচ্ছে। প্রবল হচ্ছে প্রাইভেট কোচিং। ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে পাস করা পর্যন্ত সর্বস্তরে টাকার শাসন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হু-হু করে বিস্তৃত হচ্ছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা তাতে যোগ দিচ্ছেন। তাদের নাম বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। অনেকে খণ্ডকালীন পড়াচ্ছেন। কনসালট্যান্সি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শিক্ষাদান ও গবেষণার তুলনায়। বাণিজ্য যাকে ধরে, তার আর রক্ষা থাকে না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাণিজ্যের বাইরে আনতে না পারলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া কঠিন হবে।
শিক্ষাঙ্গনকে দ্বিতীয় গৃহ হিসেবে বিবেচনা করা অসংগত নয়। শিক্ষার্থীরা গৃহে যে জীবন পায়, সেটা সংকীর্ণ ও পারিবারিক। বিদ্যালয়ে এসে তাদের মুক্তি ঘটে। তারা সামাজিক হয়। যেমন বেড়ে ওঠে, তেমনি বিস্তৃত হয়। এটা চিরকালের সত্য। এ কালের বাংলাদেশে গৃহ আরও সংকীর্ণ, বিপন্ন হয়েছে। পরিবার আগের মতো নেই। শিক্ষাঙ্গনের দায়িত্ব ও কর্তব্য তাই বেড়ে গেছে। তাকে এখন দ্বিতীয় নয়, প্রথম গৃহই হতে হবে। বিকল্প নয়, পরিপূরকও নয়; অগ্রবর্তী। ছাত্রকে সে পথ দেখাবে; উদ্বুদ্ধ করবে সামাজিক হতে। শ্রেণিকক্ষ এবং তার বাইরে অনুশীলন ঘটবে যেমন বুদ্ধি ও মেধার, তেমনি পরিচর্যা ঘটবে তার সামাজিক সত্তার। সে মিলতে শিখবে, মিশতে শিখবে। তার ভেতরকার গুণগুলো বিকশিত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমরা যেমন সরকারি দল এবং কুৎসিত বাণিজ্যের অধীনে দেখতে চাইব না, তেমনি চাইব না সমাজের অধস্তন করে রাখতে। কেননা, তারা ইতোমধ্যে যথেষ্ট অধঃপতিত হয়েছে, আরও হতে থাকবে। বিদ্যালয় যদি সমাজের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে সমাজে এখন যেসব বিষ কার্যকর রয়েছে, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং হয়তোবা ওইসব বিষক্রিয়ার বিতরণ ব্যবসারই অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
সমাজে রয়েছে হিংস্রতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অসহিষ্ণুতা ও নির্লজ্জ মুনাফাখোরি। বিদ্যালয়ের কাজ হওয়া চাই এদের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করে স্নেহ-ভালোবাসা, সামাজিকতা, সহিষ্ণুতা ও নিঃস্বার্থপরতার অনুশীলন যাতে ঘটে তার ব্যবস্থা গ্রহণ। ছেলেমেয়েরা শিখবে ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে। বিদ্যালয়ে গিয়ে খুশি হবে এবং গৃহে খারাপ যা শিখেছে তা ভুলে যাবে।
শিক্ষকরা কাজ করবেন ক্লাসরুমে; ক্লাসের বাইরেও। ক্লাসরুমে পড়াবেন, ক্লাসের বাইরে সাংস্কৃতিক কাজ ও খেলাধুলায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, নাটক, লেখা, পত্রিকা প্রকাশ, পাঠচক্র, বিজ্ঞান মেলা, চিত্রকলা প্রদর্শনী, খেলাধুলা– সবকিছু সমানে চলবে। মুখরিত থাকবে অঙ্গন; প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে; প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলবে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের। তৈরি হবে নেতৃত্ব, পাওয়া যাবে বীরত্ব। এই দুয়েরই আজ খুব দরকার। তরুণ সমাজ সামনে দৃষ্টান্ত পায় না; দৃষ্টান্ত তাদের নিজেদের ভেতর থেকেই যাতে বের হয়ে আসতে পারে, সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকা চাই।
নির্বাচনকে ভয় পেলে চলবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা রাখি, তবে সে-আশার ভিত্তিটাকে গড়ে তুলতে হবে বিদ্যালয়েই। সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা চাই। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী থাকবে, যারা সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ার বিভিন্ন এলাকায় সহপাঠীদের পক্ষে অনুশীলনের ক্ষেত্র তৈরি করবে। সঙ্গে শিক্ষকরাও থাকবেন অবশ্যই। তারা উদ্বুদ্ধ করবেন, অংশ নেবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষা পাসের কেন্দ্র হবে না; হবে মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অনুশীলনস্থল। নইলে আমরা এগোব কী করে?
এই দুই পদক্ষেপের সঙ্গে আরও একটি কাজে হাত দেওয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতেই। সেটি হলো মূলধারাকে বেগবান ও শক্তিশালী করা। মূলধারা মাদ্রাসা শিক্ষা নয়। যেমন নয় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাও। এটি হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ধারা। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাদান চাই। কথাটা খুবই দুঃসাহসিক শোনাচ্ছে। কিন্তু এর তো কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকদের মর্যাদাবান করতে হবে। শিক্ষাদান যে অন্য পেশা থেকে স্বতন্ত্র– এই বোধটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকের মর্যাদার জন্য তার বেতন বৃদ্ধি প্রয়োজন। আরও বড় প্রয়োজন তাকে চরিতার্থতা দান। যেন তিনি মনে করেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তো বটেই, অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক সম্মানের স্থান পাবেন।
সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন করেছেন। ওই আন্দোলন দমাতে পুলিশ শিক্ষকদের বেধড়ক শারীরিক নির্যাতন করেছে। আক্রান্ত একজন শিক্ষক করজোড়ে এক কনস্টেবলকে বলছেন, ‘স্যার, আমাকে মারবেন না, আমি শিক্ষক।’ এতে শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মান-মর্যাদা কোন স্তরে সরকার নামিয়ে দিয়েছে, সেটা আর অপ্রকাশ্য থাকেনি। সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। আমিও শিক্ষক। তাই নিজেকে ওই আক্রান্ত শিক্ষকের অবস্থানের সঙ্গে বিবেচনা করে আঁৎকে উঠেছি।
ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদের বীর ও নেতা হিসেবে মানবে। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, তাঁকে অনুসরণ করবে। শিক্ষকরা যাতে গৃহশিক্ষকতা না করে;, কনসালট্যান্সির পেছনে না ছোটেন; বাণিজ্যকবলিত না হন এবং দলীয় রাজনীতির খপ্পরে না পড়েন, সেদিকে লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমাদের শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দল সব পেশাতেই দলীয় বিভাজন নিয়ে এসেছে। শিক্ষকতার পেশাকে যদি তারা অব্যাহতি দেয় তবে জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।