মব সহিংসতা শূন্য সহিষ্ণুতাই সমাধান
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে মব সহিংসতা হইতে বাহির হইয়া আসিবার যেই মন্তব্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার একটি গ্রন্থ-মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে করিয়াছেন, উহা সময়োপযোগী। বস্তুত মব সহিংসতার বর্ধনশীলতার চিত্র গত ১৬ মাস ধরিয়াই চলমান। এই সহিংসতার মাধ্যমে একটি মহল কেন স্বীয় হস্তে আইন তুলিয়া লইতেছে– উহার রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। সরকারের তরফে মব সন্ত্রাসে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা বলা হইলেও উহার সহিত সংশ্লিষ্টদের বিচারের নজির না থাকিবার কারণে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হইতেছে।
বস্তুত মব যে এখন বর্ধনশীল– মানিকগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনাই উহার প্রমাণ। সেইখানে একদিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে। উপরন্তু তাঁহার ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটিয়াছে। আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাই এবং এই ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা হতাশাজনক। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলিয়াছেন, গণতন্ত্রের প্রধানতম কথা হইতেছে, অন্যের মত সহ্য করিতে হইবে। উহার অন্যথা হইলেই তখন সহিংসতা দেখা দেয়।
তিনি ইহাও যথার্থ বলিয়াছেন, গণতন্ত্রের মূলকথা হইতেছে, অপরের সহিত একমত না হইতে পারিলেও তাহার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে জীবন দিয়া হইলেও রক্ষা করিতে হইবে। বস্তুত অন্যের মতকে সহ্য না করিবার বিষয়টিই মব সহিংসতার জন্ম দিয়া থাকে। বিএনপির মহাসচিব মব সহিংসতার বিষয়টি যেইভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকরূপে চিহ্নিত করিয়াছেন, উহার সহিত দ্বিমতের অবকাশ সামান্যই। গণতান্ত্রিক সমাজের যেই ধারণা, সেইখানে প্রত্যকে প্রত্যেকের মতের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল থাকেন। এমন সমাজ যেইখানে, নির্দ্বিধায় প্রত্যেকে তাঁহার মত প্রকাশ করিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে নাগরিকদের যদ্রূপ সরকারের রোষানলে পড়িবার ভয় থাকে না, তদ্রূপ অন্য নাগরিক হইতেও তিনি নিরাপদ বোধ করেন।
আমরা দেখিয়াছি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন-এমএসএফ প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠিয়া আসিয়াছে, চলতি বৎসরের প্রথম ১০ মাসেই সাড়ে তিনশ গণপ্রহারের অঘটন ঘটিয়াছে, যাহাতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন এবং গুরুতর আহত প্রায় চারশত। বস্তুত মব সহিংসতা কেবল জানমালের ক্ষতির কারণই নহে, তৎসহিত ইহাতে জনজীবনে আতঙ্ক তৈয়ার করে। এহেন ভীতিকর পরিস্থিতি একটি সমাজের জন্য কোনোভাবেই উত্তম ফল বহিয়া আনে না।
আমরা মনে করি, জননিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে মব সহিংসতা কঠোর হস্তে দমন করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার বিকল্প নাই। সরকারের দিক হইতে তাহাদের প্রতি কঠোর হইবার বার্তা দেওয়ার পরও উহার বাস্তবায়ন না হইবার কারণ খতাইয়া দেখা দরকার। নাগরিকদেরও সজাগ থাকিতে হইবে। কোথাও মব সহিংসতা দেখিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত কিংবা সংগঠিত হইয়া উহাকে রুখিয়া দিতে হইবে।
বিএনপির মহাসচিব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মব সহিংসতা বন্ধের আহ্বান এমন সময়ে জানাইয়াছেন যখন নির্বাচন সমুপস্থিত। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য এই জাতীয় নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখিবার বিকল্প নাই। সেই কারণেও মব সহিংসতা রোধ করিতে হইবে। ইতোপূর্বে আমরা দেখিয়াছি, নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে বাধা, মাজারসহ বিবিধ স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে। এই সকল অঘটনও অসহিষ্ণুতার নামান্তর। সামাজিক সহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলিরও দায়িত্ব রহিয়াছে। আমরা মনে করি, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিরও করণীয় রহিয়াছে। তজ্জন্য দলটির মহাসচিবের বক্তব্য আশাজাগানিয়া এই অর্থে, তাহারা গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই মুহূর্তে যদ্রূপ মব সহিংসতা বন্ধে ভূমিকা রাখিবে, তদ্রূপ নির্বাচনের পরও এই ক্ষেত্রে সোচ্চার হইবে।