শেখ হাসিনার অডিও ফাঁস ও মানবতাবিরোধী অভিযোগ: ভারত এখনো আগের অবস্থানে অনড়

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুলি চালানোর নির্দেশ সংবলিত একটি অডিও ফাঁস এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পরও ভারতের অবস্থানে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। দিল্লির ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা এখনো কার্যত শূন্য।
গত ১১ মাস ধরে ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এ দুই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে নিয়মিতভাবেই তিনি সামাজিক মাধ্যমে দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে ৮ জুলাই তার সর্বশেষ ‘লাইভ’ সম্প্রচার হয়। কিন্তু সেখানে আলোচিত অডিও বা চার্জশিট– কোনোটিই আসেনি আলোচনায়।
অন্যদিকে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একটি ফেসবুক পোস্টে বিবিসি নির্মিত তথ্যচিত্রে অডিও ফাঁসকে "অপসাংবাদিকতার নির্লজ্জ নজির" বলে মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার পক্ষে সাফাই গাইছেন।
বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেন, "রাষ্ট্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বিবিসির তদন্তেই প্রমাণিত হয়েছে।" সেইসঙ্গে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান তাকে আর আড়াল না করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
তবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকরা ব্যক্তিগত আলোচনায় জানিয়েছেন, তারা সে পথে হাঁটছে না। তাদের যুক্তি—
১. শেখ হাসিনাকে যে পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তি অক্ষুণ্ন।
২. একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে ফাঁস করা হলে, সেটি ভারতের অবস্থান পাল্টানোর যথেষ্ট কারণ নয়।
৩. বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া আদৌ কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ—সে প্রশ্ন ভারত এখনও বহাল রেখেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দিল্লিকে একটি ‘নোট ভার্বাল’ পাঠিয়ে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে অনুরোধ জানায়। ভারত সেই চিঠি গ্রহণ করলেও গত সাত মাসে এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “আমাদের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও, যদি কোনো দেশ মনে করে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হবেন, তাহলে প্রত্যর্পণ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে মামলা পরিচালনার পদ্ধতি, আইনজীবীদের নিরাপত্তা, এবং আদালতের অবস্থা দেখে ভারতের বিশ্বাস নেই যে এটি কোনো সুষ্ঠু বিচার। সে কারণে চার্জশিট গঠনের পরও ভারতের অবস্থানে পরিবর্তন হয়নি।
ভারতের একাধিক সাবেক কূটনীতিকের মতে, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ অনুরোধ মেনে না নেওয়ার পেছনে আসল কারণ রাজনৈতিক। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে ভারতের আস্থাভাজন ও ‘পরীক্ষিত মিত্র’ হিসেবে কাজ করেছেন শেখ হাসিনা। এই অবস্থায় সংকটে তাকে ফিরিয়ে দিলে দিল্লি বার্তা দেবে—“ভারত আর কারও উপর ভরসা রাখে না।” ভবিষ্যতের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য এ ধরনের ‘অবিশ্বাস’ বার্তা ভারত দিতেই চায় না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানান, শেখ হাসিনার মুখে লাগাম পরানোর দাবি বাংলাদেশ বহুবার করলেও ভারত কখনোই সেটি আমলে নেয়নি। তার ভাষায়, “তিনি ভারতের একজন অতিথি—রাজনৈতিক বন্দি নন। তার মুখে লাগাম পরানোর কোনো প্রয়োজন ভারত অনুভব করে না।”
গত মাসে লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এ বিষয়ে জানালে মোদি বলেন, “এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা কারও মুখ বন্ধ করতে পারি না।”
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অডিও ফাঁস ও চার্জশিট গঠনের বিষয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দেয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্রের মতে, “এই বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। যদি কিছু বলার প্রয়োজন হয়, শেখ হাসিনা নিজেই বলবেন।”