শিশু যৌন নির্যাতন নিয়ে যা জানা জরুরি

ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো শিশুকে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নিপীড়ন করা, উদাসীনতা বা অবহেলার কারণে তার ক্ষতিসাধন করা—এই সবই শিশু নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায় কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার কি না। জেনে রাখুন, এসব ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার করণীয় কী।
শিশু যৌন নির্যাতন কী
শিশুর সঙ্গে যেকোনো ধরনের যৌন কার্যকলাপই শিশু যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। শিশুরা কোনো ধরনের যৌন কার্যকলাপে সম্মতি দিতে পারে না। একটা শিশুর সঙ্গে এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা এমন এক অপরাধ, যা বছরের পর বছর ভুক্তভোগী শিশুর ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। একজন অপরাধী যে শুধু সামনাসামনি দেখা বা স্পর্শ করার মাধ্যমেই শিশুদের যৌন নিপীড়ন করে তা নয়, এই অপরাধ বিভিন্নভাবেই সংঘটিত হতে পারে। যেমন—
শিশুর সামনে নগ্ন হওয়া কিংবা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অশ্লীলভাবে প্রদর্শন।
যৌন কামনা নিয়ে স্পর্শ করা। সহবাস।
একজন নাবালকের উপস্থিতিতে হস্তমৈথুন কিংবা এই কাজ শিশুকে দিয়েই করানো কিংবা নাবালককে হস্তমৈথুন করতে বাধ্য করা।
অশ্লীল কথোপকথন, ফোন কল, খুদে বার্তা বা ডিজিটাল মাধ্যমে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ।
শিশুদের অশ্লীল ছবি বা ভিডিও তৈরি, মালিকানা বা শেয়ার করা।
যোনি, মুখ বা পায়ুপথ কিংবা অন্য যেকোনো মাধ্যমে একজন নাবালকের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া।
শিশুদের যৌন পেশায় নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে পাচার করা।
একজন নাবালকের সঙ্গে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ যেকোনো যোগাযোগ।
শিশু যৌন নির্যাতনকারীদের স্বরূপ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী এমন কেউ হয়ে থাকে, যাকে শিশু বা তার পরিবার চেনে। ১৮ বছরের কম বয়সী ৯৩ শতাংশ ভুক্তভোগী নির্যাতনকারীকে আগে থেকেই চেনে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা নিজেরাও অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়। ভুক্তভোগীদের অপরাধীদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সম্পর্ক থাকতে পারে। অপরাধী হতে পারে একজন বড় ভাই/বোন বা খেলার সাথি, পরিবারের সদস্য, একজন শিক্ষক, একজন কোচ বা প্রশিক্ষক, একজন তত্ত্বাবধায়ক অথবা ভুক্তভোগী শিশুর বন্ধুর মা–বাবা।
সিক্স ইন ওয়ান নামের এক ওয়েবসাইটের গবেষণা থেকে জানা যায়, শিশু যৌন নির্যাতন হলো শিশুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার প্রতি করা নিষ্ঠুর আচরণের ফল, যা নির্যাতনকারী ব্যক্তির সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়।
নির্যাতনকারীরা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে যৌন নির্যাতন সম্পর্কে চুপ থাকার জন্য ভুক্তভোগীদের বাধ্য করতে পারে। নির্যাতনকারীরা প্রায়ই শিশুদের ভয় দেখানোর জন্য তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারও করে। শিশুটিকে নির্যাতনকারী বলতে পারে যে সে যা করেছে, তা খুবই স্বাভাবিক এবং কাজটি করে সে খুব আনন্দ পেয়েছে। শিশু তার কথামতো কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে বা অভিভাবকদের কাউকে বলার পরিকল্পনা করলে নির্যাতনকারী তাকে হুমকি দিতে পারে। শিশু যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে শুধু শারীরিকভাবেই একজন শিশুর ক্ষতি করা হয় না; এর মাধ্যমে তার বিশ্বাস চিরতরে ভঙ্গ করা হয়, তার প্রতি করা হয় কর্তৃত্বেরও অপব্যবহার।
যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার লক্ষণ কী কী
শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো সব সময় সহজেই ধরা পড়ে না এবং কিছু ভুক্তভোগীর মধ্যে স্পষ্ট কোনো লক্ষণ না–ও থাকতে পারে। অপরাধী এমন কেউ হতে পারে, যাকে আপনি দীর্ঘদিন ধরে চেনেন বা বিশ্বাস করেন; যে কারণে অনেক সময় অনেক লক্ষণ চোখে পড়লেও আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন। তাই কিছু সাধারণ লক্ষণ সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে—
শারীরিক লক্ষণ
যৌনাঙ্গ বা পায়ুপথে রক্তপাত, ক্ষত অথবা ফুলে যাওয়া।
যোনিপথে অস্বাভাবিক এবং দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব।
রক্তাক্ত, ছিঁড়ে যাওয়া অথবা দাগযুক্ত অন্তর্বাস বা পোশাক।
হাঁটতে বা বসতে অসুবিধা।
ঘন ঘন প্রস্রাবে ইনফেকশন।
পেটব্যথা এবং প্রায়ই পাতলা পায়খানা হওয়া।
বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও হঠাৎ করে বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করতে শুরু করা।
যৌনাঙ্গে ব্যথা, চুলকানি অথবা জ্বালাপোড়া।
শরীরে আঁচড় বা কামড়ের দাগ।
অনিদ্রা, দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ জেগে ওঠা।
ক্ষুধামান্দ্য, ইটিং ডিজঅর্ডার, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া।
আচরণগত লক্ষণ
স্বাস্থ্যবিধিতে পরিবর্তন, যেমন গোসল করতে না চাওয়া কিংবা বারবার গোসল করা।
ভীতসন্ত্রস্ত আচরণ।
বিষণ্নতা বা পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) বিভিন্ন লক্ষণ।
উদ্বিগ্নতা, পড়াশোনাসহ বিভিন্ন জরুরি বিষয় ভুলে যাওয়া, আবেগহীনতা।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
মাদকাসক্তি।
আত্মহত্যার প্রবণতা (বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে)।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতি বা পরীক্ষার ফল নিম্নগামী হওয়া।
বয়সের অনুপযুক্ত যৌন আচরণ বা যৌনতা–সম্পর্কিত জ্ঞান। যেমন যেখানে–সেখানে কাপড়চোপড় খুলে ফেলা, শারীরিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত আচরণগুলো নকল করে অন্যদের দেখানো কিংবা খেলাচ্ছলে নিজে নিজেই করতে থাকা।
ভাইবোনদের জন্য খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকা।
নিজের বয়সের তুলনায় ছোটদের মতো আচরণ করতে শুরু করা। যেমন পড়াশোনা শুরু করা একটা শিশু হঠাৎ করে আঙুল চুষতে শুরু করতে পারে, যা হয়তো সে অনেক আগেই করা ছেড়ে দিয়েছিল।
বাড়ি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে যাওয়া।
নিজের ক্ষতি করা। যেমন ব্লেড দিয়ে হাত-পা কেটে ফেলা, কাপড়চোপড় বা ঘরের জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
শারীরিক সংস্পর্শে ভীতি অনুভব করা। যেমন মা-বাবা আদর করে জড়িয়ে ধরতে চাইলে বা পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দিতে চাইলেও ভয়ে দূরে সরে যাওয়া।
অন্তর্বাস, প্যাড ইত্যাদি সবার এমনকি মায়ের কাছ থেকেও লুকাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া।
কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ভয় পাওয়া এবং তার কাছে যেতে না চাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুরা শুধু যে নির্যাতনকারী, শুধু তার কাছেই নয়, তার মতো চেহারার বা শারীরিক গড়নের অন্য ব্যক্তিদের কাছে যেতেও ভয় পায়।
সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে হবে
জরুরি অবস্থায় সাহায্যের জন্য ৯৯৯–এ ফোন করতে হবে। ৯৯৯–এর পরামর্শকদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা ও আইনি বিচারের জন্য পরবর্তী সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
গুরুতর অবস্থায় শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে সুচিকিৎসা দিতে হবে। লোকলজ্জা এবং শিশুর ভবিষ্যতের ভয়ে চিকিৎসকদের কাছে কিছু গোপন করবেন না। কারণ, তারা যদি বুঝতেই না পারেন যে আপনার শিশুর সঙ্গে কী ঘটেছে, তাহলে তাঁরা যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা সহজে করতে পারবেন না। এতে শিশুর প্রাণহানির আশঙ্কাও থাকে।
সূত্র: রেইন ডটঅর্গ, চাইল্ড সার্ভিস প্রটেক্টিভ ম্যানুয়াল, কুইন্সল্যান্ড গবর্নমেন্ট
