প্রকৃত বন্ধু কে?

বন্ধুর জন্য জীবন দেওয়ার নজির যেমন আছে, তেমনি আছে বন্ধু হয়ে জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বন্ধু আসলে কে? সব সহপাঠী বন্ধু না, আবার সহকর্মীদের মধ্যেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। সব কথা কি সব বন্ধুকে বলা যায়? কীভাবে বুঝবেন বন্ধুত্বের সীমারেখা?
ছোটবেলায় বন্ধুত্ব বলতে আমরা বুঝতাম একসঙ্গে খেলা করা, হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, ক্লাসের ফাঁকে দুষ্টুমি কিংবা টিফিন ভাগ করে খাওয়া। কৈশোর বা তারুণ্যে গিয়ে বদলে যায় সেই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। তখন বন্ধু মানে যার কাঁধে মাথা রেখে মনের কষ্ট ভাগ করে নেওয়া যায়, যাকে বলা যায় মনের গোপন সব কথা, যার সঙ্গে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বলা যায়।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পৌঁছে বন্ধু হয়ে যায় পরম স্বজনের মতো। ক্লাস, লেকচার ভাগাভাগি থেকে শুরু করে অ্যাটেনডেন্স দিয়ে দেওয়া, এক প্লেট খাবার কিংবা এক কাপ চা ভাগ করে নেওয়া, নতুন কোনো শহর কিংবা নতুন কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, এক রকম পোশাক বানানো কিংবা ঈদে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা; এসব দিয়েই তখন বন্ধুত্বের গভীরতা মাপি আমরা।
এই পর্যায়ে দেখা যায় ক্লাসের, ব্যাচের কিংবা হলের প্রায় সবার সঙ্গেই সবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। সবাই সবার সম্পর্কে প্রাথমিক সব তথ্যই জানি, অন্য কারও সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তখন বলি, ‘ও আমার বন্ধু।’
এরপরই আসে কর্মজীবন। দিনের অন্তত আট ঘণ্টা কাটে সহকর্মীদের সঙ্গে, অফিসভেদে তা আরও বাড়ে। একসঙ্গে অফিস যাওয়া-আসা, দুপুরের খাবার ভাগ করে খাওয়া, কাজের ফাঁকে ক্যানটিনে কিংবা অফিসের নিচে টংদোকানে চা পান করা, জীবনের সুখ-দুঃখের সব গল্প ভাগ করে নেওয়া শুরু হয় তখন। সেই সময় মনে হয় এরাই পরম বন্ধু।
কিন্তু আসলেই কি ক্লাসের সব সহপাঠী কিংবা সহকর্মীরা ‘বন্ধু’? আমরা আসলে কাদের বন্ধু বলব? কাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব মনের একান্ত গোপন কথা? কিংবা আদৌ বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় একান্ত সব বিষয়?
এসব বিষয়েই জানতে চেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাপল কাউন্সিলর রউফুন নাহারের কাছে। কাকে আমরা বন্ধু বলব, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্ধু হলো সে, যার কাছে আমরা আরাম বোধ করব। যে আমার কথা শুনবে, প্রয়োজনের সময় যথাযথ সাপোর্ট নিয়ে হাজির হবে, যার কাছে আমরা নিরাপদ বোধ করব।’
বন্ধুত্বকে একটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করে রউফুন নাহার বলেন, ‘বন্ধুত্ব হলো সম্পর্কের একটা ধরন। স্বামী-স্ত্রীও একে অন্যের বন্ধু হতে পারেন। এমনকি বউ-শাশুড়িও হতে পারেন বন্ধু; যদি তাঁদের সম্পর্কে আরাম থাকে, কথা বলার পরিবেশ থাকে। এ জন্যই আমরা সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলি। যেন সন্তান তার মনের সব কথা ভয় ছাড়া, নির্বিঘ্নে বলতে পারে। যেন সে বাবা-মায়ের কাছে নিরাপদ বোধ করে। মোটকথা বন্ধু সে-ই, যার কাছে আমরা আরাম বোধ করি, নিরাপদ বোধ করি।
যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল বেটারহেল্পের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে প্রয়োজনের সময় আপনাকে সমর্থন দেয়, আপনার জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে, আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায্য করে, মানসিকভাবে শক্তি জোগায়, যে সৎ, যে আপনাকে কোনো ধরনের প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই ভালোবাসে; সে-ই আপনার বন্ধু।
যত ভালো বন্ধুই হোক না কেন, তাকে কি সব কথা বলা যায়? তার সঙ্গে কি ভাগ করে নেওয়া যায় মনের সব গোপন কথা?
সব বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সীমারেখা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন মনোবিদ রউফুন নাহার। তাঁর মতে, নিজের গোপন কথা কাউকে বলার আগে সব সময় এটা মাথায় রাখা উচিত যে এই কথা পরবর্তী সময়ে দুজনের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না। কারণ, মানুষ সব সময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ১০ মাস আগের জীবনের সঙ্গে পরের জীবন মেলানো যায় না। স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কগুলোও পরিবর্তিত হয়। তাই নিজের, পরিবারের বা অন্য কারও গোপন কথা বলার আগে, নিজের দুর্বলতা প্রকাশের আগে সম্পর্কের সীমারেখাটুকু বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
রউফুন নাহার বলেন, ‘খুব মনঃকষ্টের সময় যদি আমরা মনে করি যে প্রেমিক, স্বামী কিংবা বন্ধু আমার থেরাপিস্টের মতো কাজ করবে; তাহলে সেটা ভুল হবে। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রফেশনাল হেল্প নিতে হবে। এতে গোপন কথা প্রকাশ হওয়ারও ভয় থাকবে না, আবার মনোবিদ বা কাউন্সেলর মন দিয়ে কথা শুনে সমস্যার সমাধানের পথও দেখাতে পারবেন।’
সহকর্মীদের সঙ্গেও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে পেশাগত সীমারেখা মেনে চলার পরামর্শ দিলেন তিনি। কারণ, পেশাজীবনে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রতিযোগিতার বিষয় থাকে, নিয়মকানুনের বেড়াজাল থাকে। সে ক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে, একসঙ্গে চমৎকার সময় কাটানো যেতে পারে, সময় উপভোগ করা যেতে পারে। কিন্তু নিজের বা পরিবারের একান্ত কথাটি জানানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকাই ভালো।
