রাবিতে শিক্ষকের চেম্বারে ছাত্রী ও সমন্বয়ক- সাংবাদিকের চাঁদাবাজি বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক-ছাত্রীকে নিয়ে সৃষ্ট ঘটনায় দুই সাংবাদিক, এক সমন্বয়ক ও এক সাবেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছে সংশ্লিষ্ট ছাত্রী। অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছে অভিযুক্ত দুই সাংবাদিক। শনিবার (১৭ মে) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেট চত্বরে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা।
ওই ছাত্রীর নাম মারিয়া খাতুন (২৫)। তিনি ফাইন্যান্স বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক হলেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ। এঘটনায় ছাত্রী মারিয়া খাতুন বাদী হয়ে মতিহার থানায় একটি অভিযোগও জানিয়েছেন।
অভিযোগে বিবাদীরা হলেন- আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও দৈনিক খবরের কাগজের রাবি প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম সুমন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাবির সমন্বয়ক ও রাবি আইবিএ- এর শিক্ষার্থী মো. আতাউল্লাহ্ এবং ইতিহাস বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও দৈনিক কালবেলা'র রাবি প্রতিনিধি সাজ্জাদ হোসেন সজিব।
ছাত্রী মারিয়া খাতুনের দাবি, তিনি পড়াশোনা বিষয়ে কথা বলার জন্য শিক্ষকের চেম্বারে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে ঢুকে অভিযুক্ত চারজন তাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং শারীরিক ও মানসিক হেনস্তা করেন। একপর্যায়ে তাকে মারতে যায় এবং ধর্ষণের হুমকি প্রদান করে। পরবর্তীতে শিক্ষক মো. হেদায়েত উল্লাহ'র থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করে এবং ঘটনার দিন এক লাখ ও পরের দিন দুই লাখ টাকা দিতে বাধ্য করে।
তবে, সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। তাদের দাবি, তাদের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র একটি অনৈতিক ঘটনার যথাযথ প্রতিবাদ ও প্রশাসনকে অবহিত করা।
সংবাদ সম্মেলন ছাত্রী মারিয়া খাতুন বলেন, গত ১১ মে বিকাল ৫টার সময় মো. হেদায়েত উল্লাহ্ স্যারের চেম্বারে পড়াশুনা বিষয়ে দেখা করতে যাই। হঠাৎ ওই চারজন চেম্বারে ঢুকে পড়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং আমাকে শারীরিক ও মানসিক হেনস্তা করতে থাকে। এক পর্যায়ে আমার ভিডিও করতে থাকে এবং স্যার সেটা দেখে তাদের নিষেধ করে। পরে ওই চারজন আমাকে মারতে আসে এবং আমাকে ধর্ষণের হুমকি প্রদান করে। এরপর মো. হেদায়েত উল্লাহ স্যারের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করে এবং ঘটনাস্থলেই নগদ টাকা প্রদান করতে হবে বলে জানায়।
তিনি আরও বলেন, স্যার বুথ থেকে নগদ এক লক্ষ টাকা তুলে নিয়ে এসে সুমনের হাতে প্রদান করে। বাকী চার লক্ষ টাকা প্রদানের পর তাদের মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ডিলিট করে দিবে মর্মে জানায় তাঁরা। স্যার গত ১২ মে দুপুর ১টার পরে সাকিব ও সুৃমনকে আরও ২ লক্ষ টাকা প্রদান করে। বাকী দুই লক্ষ টাকা ১৮ মে স্যার প্রদান করবে বলে জানায়। কিন্তু তাঁরা ১৪ মে তাদের ধারণ করা ভিডিওটি ফেসবুক ও গনমাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। এছাড়া ওই চারজন আমাকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করে।
ওই ছাত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরে অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন অভিযুক্ত দুই সাংবাদিক। তারা বলেন, গত ১১ মে (রবিবার) সন্ধ্যায় এক স্যারের মাধ্যমে ঘটনা সম্পর্কে জেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্যারের অনুমতিক্রমে আমরা সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, রুমের লাইট বন্ধ। আমরা নক করলে স্যার নিজেই দরজা খুলে দেন। তখন আমরা রুমে প্রবেশ করি এবং স্যারের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে টেবিলের নিচে ওই নারী শিক্ষার্থীকে লুকিয়ে থাকতে দেখি। পরে স্যার নিজেই ছাত্রীকে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনেন। এসময় ছাত্রীটি অনুরোধ করেন, ভিডিও বা সংবাদ প্রকাশ যেন না করা হয়—অন্যথায় তিনি আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে হুমকি দেন।
তাঁরা আরও বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা প্রক্টর স্যারকে কল করি বিষয়টি জানানোর জন্য। পরে হেদায়েতউল্লাহ স্যারের অনুরোধে আমরা প্রক্টর স্যারকে আর ঘটনা খুলে বলিনি। এসময় ওই শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা তখন ভিডিও প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তীতে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যারকে জানানো হয়। স্যার আমাদের একটি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন এবং জানানো হয়, অভিযোগকারীদের পরিচয় গোপন রেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের অজ্ঞাতে একটি সোর্সের মাধ্যমে ঘটনার ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র একটি অনৈতিক ঘটনার যথাযথ প্রতিবাদ ও প্রশাসনকে অবহিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রীর তোলা চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত নাজমুস সাকিবও। তবে, অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরেক অভিযুক্ত সমন্বয়ক মো. আতাউল্লাহ'র সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি সহযোগীতা করেননি। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে মন্তব্য জানাতে চাইলেও পরে আর জানাননি। পরবর্তীতে মুঠোফোনে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
অভিযুক্ত চারজনকে কোনো টাকা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ বলেন, হ্যা, আমি তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন মিলিয়ে তিন লক্ষ টাকা দিয়েছি। প্রথম দিন তাৎক্ষণিক এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। কারণ তাঁরা ওখানে মেয়েটিকে রেপ করার হুমকি দিয়েছিল এবং ভীতিকর একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আর দ্বিতীয় দিন আবার দুই লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ তারা প্রথমদিন হুমকি দিয়েছিল যে, 'টাকা না দিলে ভিডিওগুলো আমরা এমনভাবে প্রকাশ করবো যে, আপনার ও মেয়েটির ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।'
আপত্তিকর অবস্থায় থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো প্রমাণ থাকলে দেখানোর জন্য আমি তাঁদের বারবার বলেছি। এখানে আপত্তিকর একটা জিনিস ছিলো যে, তারা চেম্বারে ঢুকে হাঙ্গামা করলে এবং মেয়েটির গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে মেয়েটি তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছুটোছুটি করেছিল।
ছাত্রীর দেওয়া লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল মালকের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
এদিকে অভিযুক্ত দুই সাংবাদিক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে তাঁরা চারজন সহযোগী অধ্যাপক হেদায়েত উল্লাহ'র চেম্বারে গিয়েছিলেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, প্রশ্নই আসে না! কোনোরকম অনুমতি নিয়ে যায়নি। মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানতে চাওয়ার দরকার ছিল যে, প্রক্টর কিভাবে অনুমতি দিয়েছে? কোনো অনুমতিপত্র আছে কিনা।
তিনি আরও বলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় সমন্বয়ক আতাউল্লাহ আমাকে একটা কল দিয়ে শুধু বলেছিল যে, 'স্যার একজন শিক্ষকের চেম্বারে একজন ছাত্রী দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করছে।' আমি তখন ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম। ক্যাম্পাসে এসে আতাউল্লাহকে ৪-৫ বার কল দিলেও সে আর কল রিসিভ করেনি। এখন তাঁরা ওই কল দেওয়াটাকে অনুমতি হিসেবে বলে বেড়াচ্ছে। অথচ গতকাল (শুক্রবার) খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পর (থানায় অভিযোগ জানানো) থেকে তাঁরা আমাদের হাতেপায়ে ধরছে যে, 'স্যার আমাদের বাঁচান। আমরা ভুল করে ফেলেছি। আপনারা বললে মামলা হবে না।' বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে চাপও দেওয়াচ্ছে। আবার এধরণের মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের বিব্রত করছে।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, সবকিছুই এখন তদন্তের মধ্য দিয়ে যাবে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি এবিষয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আমাদের একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে পুরো ঘটনাটা জানার জন্য।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার (১১মে) বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির দিন বিকেল ৫টার দিকে ছাত্রী মারিয়া খাতুনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যাকাডেমিক ভবনের ৩০৭ নম্বর কক্ষে (নিজের চেম্বার) প্রবেশ করেন সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ।
ওইদিনের ওই কক্ষের একটি ছোটো ভিডিও ফেসবুকে গত বুধবার (১৪মে) ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, ভিডিও করার সময় ওই শিক্ষক ও ছাত্রী নিজেদের মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন। ঘটনার দুইদিন পরে ভিডিও প্রকাশ হওয়া নিয়ে ক্যাম্পাসে নানারকম গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে আর্থিক লেনদেনের কথাও তোলেন তখন।
