দক্ষতা আলোর মতো, অদক্ষতা উহার বিপরীত

এই পৃথিবীতে অপ্রয়োজনে কেহ অন্য কাহারো ভার বহন করিতে চাহে না। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে আরব্য রজনির সিন্দবাদ ও এক বৃদ্ধের কাহিনি। সিন্দবাদ যখন জাহাজডুবির পর একটি দ্বীপে একা আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন একটা ছোট্ট জলপ্রপাতের সাঁকোর নিকট প্রায় উলঙ্গ একজন মানুষকে দেখিতে পান। সিন্দবাদ ভাবিলেন, তাহার মতোই করিৎকর্মা কেহ হইবে যিনি হয়তো জাহাজডুবির পর সর্বস্ব খুয়াইয়া ঐ দ্বীপে আটকা পড়িয়াছেন।
লোকটি সিন্দবাদকে বুঝাইলেন, তাহার চলচ্ছক্তি নাই। তিনি সিন্দবাদকে বলিলেন, তাহার খুব পানির তিষ্টা পাইয়াছে। সিন্দবাদ যেন তাহাকে কাঁধে তুলিয়া ঐ দ্বীপের একটি ঝরনার নিকট লইয়া যায়। সমব্যথী হইয়া সিন্দবাদ তাহাকে কাঁধে তুলিলেন। এবং তাহার পরে সিন্দবাদের কী অবস্থা হইয়াছিল, তাহা আমরা সকলেই জানি। ঐ লোকটি সিন্দবাদের কাঁধ হইতে আর নামিতেই চাহিল না। সেই যে সিন্দবাদের কাঁধে উঠিয়া লৌহশক্ত হাতে তাহার গলা ঐ লোকটি এমনভাবে আঁকড়াইয়া রাখিল যে, সিন্দবাদ যেন দমবন্ধ হইয়াই মরিয়া যাইবার অবস্থা হইল। অতঃপর বিশেষ কৌশলে সেই লোকটিকে মারিয়া তাহার ভার মুক্ত হইতে হইল সিন্দবাদকে।
সুতরাং ইহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, এই পৃথিবীতে অপ্রয়োজনে কিংবা নিজেকে বিপদে ফেলিয়া কেহ কাহারো ভার বহন করে না। কি চাকরি, কি ব্যবসায়-বাণিজ্য, কি সমাজসংসার, রাষ্ট্র-সকল স্থানেই নিজেকে প্রয়োজনীয় ও যোগ্য হিসাবে প্রমাণ করিতেই হয়। যিনি নিজেকে প্রয়োজনীয় বলিয়া প্রমাণ করিতে পারেন না তিনি অপাঙ্ক্তেয় হইয়া পড়িবেন। নিজেকে যোগ্য করিয়া তুলিবার সবচাইতে বড় উপায় হইল-নিজের কাজ নিজে যথাযথভাবে করা। মার্টিন লুথার কিংয়ের একটি উক্তি আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করিতে পারি- 'আমরা প্রত্যেকে এক অপরিহার্য সমঝোতার জালে জড়াইয়া আছি, যাহার প্রতিটি সুতা একটি আরেকটির সহিত জুড়িয়া আছে।' আসলে এইখানে অপরিহার্যতা। যদি সেই সমঝোতা ও কাজের সুতা ছিঁড়িয়া যায়, তাহা হইলে আর অপরিহার্যতা থাকে না। আবার এই রকমও আছে যে, অনেকে নিজেকে জোর করিয়া অপরিহার্য বলিয়া মনে করেন; কিন্তু বিচক্ষণ ব্যক্তি কখনো তাহা ভাবিতে পারেন না। একজন খেলোয়াড় বিখ্যাত হইবার পূর্বেই কোচের নিকট আক্ষেপ করিতেছিলেন যে, সংবাদমাধ্যম তাহাকে গুরুত্ব দেয় না। কোচ বলিয়াছিলেন, 'আগে দারুণ পারফরম করিয়া দেখাও, দেখিবে তখন পাপ্পারাজ্জির মতো সাংবাদিকরা তোমাকে দুরবিন দিয়া খুঁজিবে।
সুতরাং বর্তমান এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ সময়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণের কোনো বিকল্প নাই। সময়ের সহিত তাল মিলাইতে হইলে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে অবিরাম যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মতৎপরতা বাড়াইতে হয়। সময়ের পরিবর্তন হইতেছে, চাহিদারও পরিবর্তন হইতেছে, পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তারও পরিবর্তন হইতেছে। আর শেষ কথা হইল-বৃক্ষের পরিচয় তাহার ফলে। একজন অযোগ্য ব্যক্তি যত পরিকল্পনাই করুন না কেন, যত সুযোগসন্ধানীই হউন না কেন, যদি শেষ পর্যন্ত তিনি অযোগ্য ও অদক্ষ থাকেন-তাহার ছাপ তিনি এড়াইতে পারিবেন না। সুতরাং নিজেকে প্রকৃত দক্ষ করিয়া গড়িয়া তুলিবারও বিকল্প নাই। আর বিকল্প নাই পরিশ্রমেরও। এই জন্য ইংরেজিতে বলা হয়, 'লার্ন ইন জব অ্যান্ড লার্ন টু বি ইন দ্য জব'। অর্থাৎ চাকুরিতে শিখো এবং চাকরির জন্যও শিখো। এই ব্যাপারে কেহ যদি নিরলস কর্মঠ হন, তাহা হইলে তাহার মূল্যায়ন হইবে নিশ্চয়ই। সূর্য উঠিলে যেমন জগতের সকল কিছু আলোকিত হইয়া যায়, দক্ষতাও তেমনি আলোর মতো ছড়াইয়া পড়ে। সুতরাং সর্বিকভাবে নিজেকে যোগ্য ও কর্মতৎপর করিবার মাধ্যমে অপরিহার্য করিতে হয়। নচেৎ অযোগ্য অপ্রয়োজনীয় লোকের ভার সিন্দবাদের মতো কেহই বহন করিবে না। তাহাকে ঘাড় হইতে নামাইবেই-আজ অথবা আগামীকাল। ইহাই জগতের বাস্তবতা।