বিসিএস প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা : কাঠামোগত সমস্যা, না প্রশাসনিক ব্যর্থতা?

বাংলাদেশে 'বিসিএস' শব্দটি যেন এক অলিখিত স্বপ্নের নাম। মধ্যবিত্ত হইতে নিম্নবিত্ত, প্রত্যন্ত গ্রাম হইতে শহরের ব্যস্ত অলিগলি-সর্বত্র তরুণদের মেধা, যোগ্যতা ও স্বপ্নের অন্যতম গন্তব্যস্থল এই বিসিএস। দেশের প্রশাসনিক কাঠামো গড়িয়া তুলিবার মূল চালিকাশক্তি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা কেবল চাকুরির নিয়োগ পরীক্ষা নহে; ইহা একটি প্রজন্মের আশা, আত্মত্যাগ আর অনন্ত প্রতীক্ষার প্রতীক। রাষ্ট্রের নানা স্তরে সেবা প্রদান, নীতিনির্ধারণ, আইন প্রয়োগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলিতে নেতৃত্ব দেন বিসিএস কর্মকর্তাগণ। প্রশাসনিক কাঠামোর প্রাণ বলিয়া বিবেচিত এই ব্যবস্থাটি আজ স্থবির হইয়া হাজারো মেধাবী তরুণ-তরুণীর স্বপ্নভঙ্গের কারণ হইয়া উঠিতেছে বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।
বর্তমানে ৪৪তম হইতে ৪৭তম পর্যন্ত চারটি বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রমে জট লাগিয়া গিয়াছে। ৪৪তম বিসিএসের কার্যক্রম চার বৎসরেও শেষ হয় নাই, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হইয়াছে ১৫ মাস পূর্বে; কিন্তু ফল প্রকাশ হয় নাই। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল লইয়া বিতর্ক উঠিল; নূতন ফল প্রকাশের পর আবার তাহা গতিহীন। এমনকি সামনের ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রমও এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়িয়াছে। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এতগুলি পরীক্ষার দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করিতে গিয়া কার্যত হিমশিম খাইতেছে।
এই জটিলতার পরিস্থিতির মূল কারণ খুঁজিতে গিয়া দেখা যায়, বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের ক্ষেত্রে পিএসসি দীর্ঘদিন ধরিয়াই একটি অনিয়ন্ত্রিত সময়সূচিতে কাজ করিয়া আসিতেছে। একদিকে কোভিড-১৯-এর প্রভাব, অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির অনুরোধে সময়সূচি বারংবার মুলতুবিসহ নানা কারণে পূর্বনির্ধারিত কাঠামো অনুসরণ করা হইতেছে না। ইহা ছাড়াও পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত নিয়োগ আটকাইয়া থাকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও অন্যান্য প্রশাসনিক জটিলতায়। লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে দীর্ঘসূত্রতা, পরীক্ষকদের দায়িত্বহীনতা, পিএসসির সদস্য স্বল্পতা, মাঝেমধ্যে প্রশ্নফাঁস-সংক্রান্ত অভিযোগ ও সমন্বয়ের অভাব মিলাইয়া প্রতিটি ধাপে তৈরি হয় নূতন নূতন প্রতিবন্ধকতা। সরকার ও পিএসসির পক্ষ হইতে সময়মতো পরীক্ষার রোড ম্যাপের প্রতিশ্রুতি আসিলেও বাস্তবে তাহার প্রতিফলন দেখা যায় নাই।
এই অব্যবস্থাপনার সবচাইতে বড় শিকার তরুণ চাকুরিপ্রার্থীরা। শিক্ষাজীবন শেষ করিয়া দীর্ঘ সময় ধরিয়া বিসিএসের প্রস্তুতি লওয়া তরুণ-তরুণীরা চরম মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক চাপে পড়িতেছেন। একটি পরীক্ষা শেষ না হইতেই নতুন সার্কুলার চলিয়া আসে; অথচ পূর্বের ফলাফল ঝুলিয়া থাকে। ফলে একজন পরীক্ষার্থীকে একাধিক পরীক্ষার জন্য বারংবার প্রস্তুতি লইতে হয়। একদিকে চাকুরি বয়স পার হইয়া যাইতেছে, অন্যদিকে মানসিক চাপ, হতাশা ও বিষণ্ণতা ভর করিতেছে তাহাদের জীবনে। হাজারো তরুণ-তরুণীর জীবনের কয়েকটি মূল্যবান বৎসর কাটিয়া যাইতেছে অনিশ্চয়তা ও অপেক্ষায়। ইহার কারণে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। প্রশাসনকে সক্রিয় রাখিবার জন্য প্রতি বৎসর যে জনবল নিয়োগ দরকার, তাহা না হওয়ায় জনসেবা ব্যাহত হইতেছে। শিক্ষা খাতে শিক্ষক নাই, স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক নাই, ফিল্ড প্রশাসনে যোগ্য কর্মকর্তার সংকট-এই সকল সমস্যার পিছনে এই নিয়োগজট বড় ভূমিকা রাখিতেছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এই সমস্যা সমাধানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করিয়াছে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট সময়রেখায় বিসিএসের প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করা, পরীক্ষার সিলেবাস আধুনিকীকরণ, তিনটি পৃথক কমিশনের প্রস্তাব (সাধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য), লিখিত পরীক্ষায় ৬০ শতাংশ পাশ নম্বর নির্ধারণ এবং ব্রেকডাউনসহ ফলাফল প্রকাশ। এই সুপারিশগুলি কাগজে-কলমে না রাখিয়া বাস্তবায়ন করা জরুরি। পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতা ও সময়সীমা নিশ্চিত করা দরকার। মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বিভাজন প্রকাশ, ভাইভা বোর্ডের অডিও/ভিডিও সংরক্ষণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় আরো স্বচ্ছতা আনয়ন করা যায়। ইহার সহিত নন-ক্যাডার নিয়োগেও নির্দিষ্ট সময়সীমা ও ভ্যাকেন্সির তালিকা নিয়মিত প্রকাশ করা উচিত। চলমান অব্যবস্থা কাটাইয়া একটি আধুনিক, গতিশীল ও স্বচ্ছ বিসিএস পরীক্ষাপদ্ধতি গড়িয়া তোলা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে। যেই পদ্ধতি তরুণদের স্বপ্ন ভাঙিবার কারণ হইবে না, বরং রাষ্ট্রগঠনে তাহাদের দায়িত্বে আত্মবিশ্বাসী করিয়া তুলিবে। প্রশ্ন হইতেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কি তাহাদের সেই সুযোগ নিশ্চিত করিতে পারিবে?