মেসি-আর্জেন্টিনার ভাগ্য বদলে দিলেন যে লিওনেল

‘লিওনেল’ – নামটার মানে সিংহশাবক। এই নামেই আর্জেন্টিনার বিখ্যাত একজনের অস্তিত্ব আছে, যিনি মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এখনও, তিনি লিওনেল মেসি। ক্লাবের হয়ে জিতেছেন অজস্র শিরোপা, ব্যক্তিগত পুরস্কার ধর্তব্যে আনলে ট্রফি কেসে জায়গাই হওয়ার কথা নয়। তবে তাতে আর্জেন্টিনার অর্জনের খাতাটা ওই সুনামটা বাদ দিলে ফাঁকাই পড়ে ছিল।
সময়টা এমনই ছিল ২০১৮ সালে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে লিওনেল মেসির চেহারা দেখলেই এখন মনে হয় যেন একরাশ আলো এসে ঠিকরে পড়ছে তার চোখে-মুখে। তবে বছর সাতেক আগে পরিস্থিতিটা এমন আদৌ ছিল না। ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় মেসির চোখে-মুখে ভর করে বসেছিল রাজ্যের আঁধার, কপাল হাত ছিল তার, দুশ্চিন্তাটা ছিল স্পষ্ট; কেন, সে প্রশ্নের জবাব সে ম্যাচেই দিয়ে দিয়েছিল আর্জেন্টিনা, ক্রোয়াটদের কাছে ৩-০ গোলে হেরে ১৬ বছর পর বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়ের শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল দলটা।
তার আগে চলে যাওয়া যাক। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে খুব কাছে থেকেও শিরোপা না পাওয়ার বেদনায় জ্বলে পুড়ে যাওয়া, এরপর ২০১৫ আর ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারের পর সে দগদগে ঘায়ে নুনের ছিটা পড়েছে আরও। এরপর যখন বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনা ওভাবে খাবি খেল, তখন মনে হচ্ছিল মেসির বুঝি আর জাতীয় দলের হয়ে কিছুই জেতা হলো না!
সাত বছর পরের আর্জেন্টিনাকে দেখলে এখন সেসব স্মৃতিকে অপরিণত অচেনা কিছু বলেই মনে হওয়ার কথা। সেই দুর্ভাগা মেসি আর আর্জেন্টিনার ভাগ্যটাকে এভাবে ১৮০ ডিগ্রি উলটে দিলেন একজন লিওনেল স্কালোনি। শুরুতে যেমন পড়লেন, লিওনেল নামের বিখ্যাত আর্জেন্টাইন লোকটা ছিলেন মেসি, তার ঠিক উল্টোটাই ছিলেন স্কালোনি। খেলোয়াড়ি জীবনে অর্জনের খাতাটা খুব বড় নয় তার। ডিফেন্ডার ছিলেন বয়সকালে, দেপোর্তিভো লা করুনিয়ার হয়ে লা লিগা, কোপা দেল রে আর সুপারকোপা দে এস্পানা, এই হচ্ছে তার অর্জন, এমন কিছু তো এখন ১৭ বছর বয়সী পুঁচকে লামিন ইয়ামালেরও আছে!
আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন একটা। ২০০৬ সালে সে বিশ্বকাপে মেসির সঙ্গে মাঠে ছিলেন মিনিট কতক। কে জানত এই জুটিটাই ১৬ বছর পর আর্জেন্টিনার খরা কাটিয়ে দেবে!
কেউ বিশ্বাসই করেনি। ২০১৮ বিশ্বকাপে মেসির আশা যখন আরও একবার ধুলোয় লুটাল, তখন সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন স্কালোনি। সেবার হোর্হে সাম্পাওলির কোচিং স্টাফের অংশ ছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের পর সাম্পাওলিকে বরখাস্ত করা হলো। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে ডাক এল তার।
মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি যে আর্জেন্টিনার কোচ হচ্ছেন, এটা বিশ্বাস করতে পারেনি খোদ আর্জেন্টাইন সংবাদ মাধ্যমও। শুরুতে তো গুঞ্জন চাউর হয়েছিল, তিনি নন, পাবলো আইমারের কাছে যাচ্ছে আর্জেন্টাইন কোচের দায়িত্ব। আইমার শেষমেশ কোচ হয়েছেন বটে, তবে তার দায়িত্বটা হয়েছে স্কালোনির সহকারীর, যেমনটা হয়েছে ওয়াল্টার স্যামুয়েলদের।
তার ওপর যে বিশ্বাস নেই, বিষয়টা আর যেই হোক দিয়েগো ম্যারাডোনা লুকাননি। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার সে বছর নভেম্বরে জনসম্মুখে ধুয়ে দিয়েছিলেন স্কালোনিকে। বলেছিলেন, ‘ওর তো রাস্তার ট্রাফিক সামলানোরও ক্ষমতা নেই! সে বিশ্বকাপে যেতে পারে বটে, তবে সেটা মোটরসাইক্লিং বিশ্বকাপে। আমাদের কাছে এত্তো এতো বিশ্বমানের কোচ আছে, আর আমরা কিনা গেলাম স্কালোনির কাছে! আমাদের আর্জেন্টাইনদের দুনিয়াটাই উল্টো, ১৮০ ডিগ্রি উল্টো পৃথিবীতে বাস আমাদের।’
পরের বছর আর্জেন্টিনা যখন ব্রাজিলের মাটিতে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিল, তখন তো সে সমালোচনার তিরগুলো সংখ্যায় বাড়ছিলই কেবল। কিন্তু আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সেসবে কান দেয়নি। তাকে ২০২২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্ব দিয়ে দেয়।
ভাগ্যিস দিয়েছিল! সে সিদ্ধান্তের যথার্থতা স্কালোনি প্রমাণ করেছিলেন ২০২১ সালেই। ব্রাজিলের মাটিতে কোপা আমেরিকা জিতে ২৮ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার। সেসব অবশ্য ম্যারাডোনা নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি, ততদিনে তিনি চলে গেছেন অন্যলোকে।
১৪ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টাইন কেউ বিশ্বকাপ জেতার কথা মুখেও এনেছেন কালেভদ্রে। কিন্তু একুশের ওই কোপা আমেরিকা আবারও স্বপ্ন দেখার সাহস দেয় আলবিসেলেস্তেদের। ২০২২ বিশ্বকাপের ফেভারিট হিসেবে ফ্রান্স আর ব্রাজিলের সঙ্গে চলে আসছিল আর্জেন্টিনার নামও। পরের বছর জুনে ইউরোজয়ী ইতালিকে যখন ৩-০ গোলে খাবি খাইয়ে ফিনালিসিমা জিতল আর্জেন্টিনা, তখন তো সে আলাপটা জোর পেয়ে গেল আরও। হবে বা না কেন? শিরোপার মঞ্চে ইউরো চ্যাম্পিয়নদের হারানোটা যে চাট্টিখানি কথা নয়!
চাপের মুখে আর্জেন্টিনার নুইয়ে পড়াটা স্কালোনি-পূর্ব যুগে ছিল একেবারে নিয়মিত দৃশ্য। সেখানেও বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন স্কালোনি। ২০২২ বিশ্বকাপের হট ফেভারিট আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচে হেরে বসল সৌদি আরবের কাছে, এরপর মেসি যখন এসে বুক চিতিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমরা আপনাদের হতাশার মহাসমুদ্রে ফেলে রেখে যাব না।’ সে কথা বলার সময়ে যে আত্মবিশ্বাসটা খেলে যাচ্ছিল মেসির চোখে মুখে, তা তো স্কালোনিরই বুনে দেওয়া!
এরপর নাটক-মহানাটক হয়েছে একগাদা। মেক্সিকো, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্নায়ুচাপ সামলে স্কালোনির দল ফাইনালে চলে আসে ক্রোয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডসের মতো দলকে হারিয়ে। সেখানে স্কালোনি দেখালেন তার আসল খেল। ফ্রান্সের দুর্বলতা লক্ষ্য করে আনহেল দি মারিয়াকে খেলালেন উল্টো পজিশনে, লেফট উইংয়ে। দুটো গোলই সেখান থেকে এলো। সে ফাইনালে অনেক নাটকের দেখা মিলেছে এরপর। তবে স্কালোনির দলই শেষমেশ শেষ হাসি হেসেছে, হেরে যাওয়ার দীক্ষা যে স্কালোনি দেননি তার দলকে! ৩৬ বছরের অপেক্ষা শেষ হয় তাতে। মেসির সঙ্গে স্কালোনিও উঠে যান আর্জেন্টিনার ইতিহাসের পাতাতে।
২০২৪ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা ফেভারিট ছিল। কোনোরূপ নাটক ছাড়াই শিরোপাটা ঘরে তুলেছে তার দল। স্কালোনি করে বসেন আরও এক রেকর্ড। ভিসেন্তে দেল বস্কের পর ইতিহাসে দ্বিতীয় কোচ হিসেবে টানা জেতেন মহাদেশীয় শিরোপা-বিশ্বকাপ আর মহাদেশীয় শিরোপা, এই তিন শিরোপা।
আরও এক বিশ্বকাপের দুয়ারে আর্জেন্টিনা। ২০২৬ বিশ্বকাপে মেসির দল আবারও শিরোপার লক্ষ্যেই যাবে যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোয়, তা বলাই বাহুল্য। এবার তার সামনে নতুন ইতিহাস। টানা চার আন্তর্জাতিক মেজর শিরোপা জেতার ইতিহাস। স্কালোনির আর্জেন্টিনা নিশ্চয়ই সে ইতিহাস লিখে তবেই থামতে চাইবে!
এতোসব ইতিহাস গড়বে আর্জেন্টিনা, চলে যাবে আরও অনেক ইতিহাসের দুয়ারে, অন্তত সাত বছর আগের এই দিনে এমন কিছু কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। এমন সব কিছু সম্ভব হয়েছে এই লিওনেলের হাত ধরে। জন্মভূমি পুহাতোয় স্কালোনির জন্মটা আজ থেকে ঠিক ৪৭ বছর আগে। আজ ১৬ মে তার জন্মদিন। দিনটা যে আর্জেন্টাইনদের জন্য পয়ামন্ত, তা আর বলতে!
