চলে এসেছে গ্রীষ্ম, গরমে লোডশেডিংয়ের শঙ্কা

গ্রীষ্মের আগমনের সাথে সাথেই বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে গ্রীষ্মকালে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা জনজীবনে মারাত্মক দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে।
এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট। আর্থিক ও জ্বালানি সংকটের কারণে পূর্ণমাত্রায় (২৬ হাজার মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। ফলে লোডশেডিং বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিএলসি) তথ্যমতে, ১৫ এপ্রিল পিক আওয়ারে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৯০ মেগাওয়াট, যার বিপরীতে চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট।
এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাস। এরপর রয়েছে কয়লা, হাই ফার্নেস অয়েল ও হাই স্পিড ডিজেল।
বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নানা জটিলতা
শুধু জ্বালানি সমস্যাই নয়, বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নানা কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াও লোডশেডিংয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। গত ৮ এপ্রিল কারিগরি ত্রুটির কারণে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং ১১ এপ্রিল রাতে দ্বিতীয় ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ চাপ পড়ে। এরপর ১৫ এপ্রিল থেকে আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় আদানির প্লান্ট থেকে।
এ ছাড়া কয়লা সংকটের কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন শুক্রবার (১১ এপ্রিল) ১ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৬২ মেগাওয়াটে নেমে আসে।
কয়লা সংকটের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) জানায়, বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য আগত কয়লা ছিল ভেজালযুক্ত। সে চালান ফেরত পাঠানোর ফলেই সংকটের সৃষ্টি হয়।
গ্রীষ্মকালে লোডশেডিংয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে জনজীবনে এবং অর্থনীতির ওপর। তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। কলকারখানা ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে, যার ফলে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অসুবিধা হবে। অনলাইন ক্লাস এবং অন্যান্য ডিজিটাল কার্যক্রম ব্যাহত হবে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হলে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়বে। জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম পরিচালনা করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যদি লোডশেডিং পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়, তাহলে সরকারকে একটা ভালোরকমের ভর্তুকি দিতে হবে, যেটা আগের সরকারও করে এসেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন
বিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, যা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলবে।
এখন এই লোডশেডিং পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এবার ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে কয়লা-গ্যাস-তেল থেকে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তেলভিত্তিক উৎপাদন খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। ফলে আমরা চেষ্টা করি তেলভিত্তিক উৎপাদন যথাসম্ভব কম করতে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের তিনটি সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথমত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক উৎপাদন, যেটা আমরা যতোটা সম্ভব কম করতে চাই। তারপর কয়লার সাপ্লাইয়ে সমস্যা হওয়া। কিছুদিন আগেও মাতারবাড়ীর জন্য আগত কয়লবাহী একটি জাহাজকে ফিরে যেতে হয়েছে। আরেকটা হলো আর্থিক সংকটে আমদানিতে ব্যাঘাত ও প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ কমে যাওয়া। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া না গেলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। হয়তো আমরা ১২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাচ্ছি, পাচ্ছি ১ হাজার এমএমসিএফডি।
লোডশেডিং কমানোর জন্য তেলভিত্তিক উৎপাদন বাড়ানো হবে কি না,এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তারা যদি বলে যে এখন আমার বেশি পাওয়ার লাগবে, তেল থেকে উৎপাদন বাড়াও, আমরা সেটাই করবো। সুতরাং বিষয়টা নির্ভর করছে বিদ্যুতের চাহিদার পূর্বাভাস ও সরকারের পলিসির ওপর।
জহুরুল ইসলাম আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বা সরবরাহ কমে যায়। সেক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে খুব একটা চাপে পড়তে হবে না। তবে খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ের কারণে হয়তো এক হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং হতে পারে। উপদেষ্টা মহোদয় প্রায়ই বলে থাকেন যে লোডশেডিং করা হবে, তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি রাখো। কিন্তু দেখা গেল যে সবমিলিয়ে পরিস্থিতি ঠিক আছে, লোডশেডিং আর দেওয়া লাগলো না। সুতরাং আমরা সবসময় কাজ করে যাচ্ছি যাতে লোডশেডিংটা না দিতে হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিডিবি বর্তমানে গ্যাস ও কয়লার মাধ্যমে ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এর বেশি উৎপাদন করতে গেলে তেলভিত্তিক উৎপাদনে যেতে হয়, যার প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ২০ টাকার মতো। এখন উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যদি লোডশেডিং পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়, তাহলে সরকারকে একটা ভালোরকমের ভর্তুকি দিতে হবে, যেটা আগের সরকারও করে এসেছে। সেসময় অর্থ মন্ত্রণালয় এটা কন্ট্রোল করতো যে এর বেশি তেল ব্যবহার করা যাবে না। আশা করছি এ সরকারেও সে কন্ট্রোলটা রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সরকার সবমিলিয়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি যেতে পারবে না। ফলে লোডশেডিংয়ের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আসলে সরকার একটা টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। আমরা হয়তো এখন শর্টটার্ম সলিউশনের জন্য তেলভিত্তিক উৎপাদন বাড়াতে পারি। কিংবা শিল্পে একটু গ্যাস কমিয়ে বিদ্যুতে দিতে পারি। যদিওবা শিল্পখাত নিজেও সংকটের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং লোডশেডিং পরিস্থিতি সামলাতে আসলে লংটার্ম পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় রয়েছে যে গ্যাস প্রচুর চুরি হয়। আবাসিকে, শিল্পে নানাভাবে গ্যাস চুরি হয়। এই চুরিটা কমালে কিছু গ্যাস বাঁচবে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিও বিদ্যুৎ খাতের সংকটে একটা বিশাল সহায়ক হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তাতেও নজর দেওয়া হচ্ছে না। ফলে আমার মতে একটা সমন্বিত মহাপরিকল্পনা না নেওয়া হলে এই সংকটটা কখনোই পুরোপুরি কাটবে না।
