বাংলাদেশ সচিবালয় সমবায় সমিতিতে লুটপাটের রাজত্ব: তদন্তে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র

৬৬ বছরের পুরোনো বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে। সমিতির কার্যক্রম ঘিরে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ, নথিপত্র গায়েব, ভুয়া সদস্য অন্তর্ভুক্তি, কোনো নিয়ম না মেনে সদস্য নির্বাচনসহ নানা গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ মিলেছে।
কোটি টাকার সম্পত্তি লোপাট, হিসাব নেই কোথাও
১৯৮২-৮৪ সালের মধ্যে গাজীপুরের ধারাইল মৌজায় সমিতির নামে কেনা হয় সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি। তবে ১৯৯৩ সালের পর দায়িত্বে থাকা নেতারা ওই জমি নিজেদের নামে লিখে নেন। অনেকে সেখানে স্থায়ী বসবাস করছেন, অনেকে বিক্রি করে চলে গেছেন। আজকের বাজারদরে যার মূল্য প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ সমিতির নথিতে জমির খতিয়ান, নামজারি, দলিল, খাজনার কোনো তথ্য নেই।
তদন্তে বলা হয়, "কোনো কমিটিই জমি আত্মসাতের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, বরং গাফিলতি করেই দায় এড়ানোর অপচেষ্টা করেছে।"
ক্যান্টিনে কোটি টাকার লেনদেন, লাভ নেই তবুও!
সচিবালয়ের ভেতর দুটি ও পরিকল্পনা কমিশনে একটি ক্যান্টিন পরিচালিত হচ্ছে সমিতির নামে। রয়েছে আরও দোকান, ফাস্টফুড স্টল, বেকারি, চা ও স্টেশনারি দোকান। গড়ে প্রতিদিন এসব থেকে ১ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়।
প্রতি মাসে ২২ লাখ টাকার টার্নওভার হলেও সমিতির লাভ নেই বলে দাবি করা হচ্ছে। অথচ রয়েছে ২৯ লাখ টাকার গ্যাস বিল, এবং বিভিন্ন পাইকারি দোকানে লাখ লাখ টাকা বাকি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এত আয় থেকেও সমিতি লাভ করতে না পারা অত্যন্ত রহস্যজনক, যা দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।"
নিয়োগনীতি নেই, অডিট হয় না, শেয়ার বিক্রি করে ভাগবাটোয়ারা
৫০ বছরে কোনো নিয়োগ বিধিমালা হয়নি সমিতির। কর্মরত ৩৩ জন কর্মচারীর বেতন-বোনাস বাকি। সদস্যদের আর্থিক লেনদেনের বার্ষিক অডিটও করা হয় না।
অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের শেয়ার ১,১০০ টাকা দরে বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা ভাগ করে নেয় বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি। তদন্তে বলা হয়, শেয়ার বিক্রি অবৈধভাবে পরিচালনা করে এই অর্থ সদস্যদের মধ্যে জনপ্রতি ১.৫ লাখ টাকা করে ভাগ করে দেওয়া হয়। অথচ এতে মাত্র ১০০ টাকা ফান্ডে জমা দেওয়া হয়েছে!
২০২৩ সালের ১৬ মার্চ ২৭ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে তদন্তে। ভোটার তালিকা আইনসিদ্ধ না হওয়ায় কমিটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া ২০২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইন লঙ্ঘন করে মোট ২,২২৯ জনকে সদস্য করা হয়েছে, যাদের সদস্যপদ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, সমিতির বর্তমান ও সাবেক কমিটি তদন্তে সহযোগিতা করেনি। হিসাবপত্র সরবরাহ করেনি, ফলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সমিতির রেজিস্টার, হালনাগাদ সদস্য তালিকা, সম্পত্তির দলিল, আয়-ব্যয়ের কোনো ট্র্যাকিং ব্যবস্থা নেই। সাধারণ সভা কিংবা বাজেট অনুমোদনের রেওয়াজও নেই।
সমিতির দীর্ঘদিনের কর্মী মো. রুহুল আমীন বলেন, “১৯৯৩ সাল থেকে কর্মরত। এখানে কেউ কল্যাণে কাজ করেনি। প্রতিদিন বাজারের নামে লাখ টাকা খরচ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ হয়।”
তিনি বলেন, “বর্তমান কমিটি সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেছে। অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের শেয়ারের ২৬ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা তারাই করেছে।”
সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, “আমার দায়িত্ব নেওয়ার সময় আগের কমিটি ঋণ রেখে গেছে, আয় হয় না। আমি কোনো টাকা নিইনি।”
তবে প্রতি মাসে ২২ লাখ টাকার ব্যবসা সত্ত্বেও আয় না হওয়া এবং শেয়ার বিক্রি করে ব্যক্তিগতভাবে টাকা নেওয়ার অভিযোগের সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।