বরিশালে চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চাই: চিকিৎসা বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের এখনই সময়

স্বাস্থ্য সেবা একটি মৌলিক অধিকার। অথচ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশাল, যুগ যুগ ধরে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। যখন আমরা উন্নয়নের কথা বলি, তখন এর প্রতিটি শাখা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, যোগাযোগ—সমভাবে বিবেচনায় আসা উচিত। অথচ বাস্তবচিত্র বলছে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রতি সেই সমতা বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তাই সময় এসেছে এই অবহেলিত অঞ্চলের পক্ষে সুনির্দিষ্ট দাবি তোলার। সেই দাবির প্রথম সারিতে থাকা উচিত—বরিশালে একটি চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল স্থাপন।
চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল: এক নতুন দিগন্ত:- সম্প্রতি চীন সরকার বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে তিনটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব হাসপাতালের মধ্যে একটি ১ হাজার শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল নীলফামারীতে, আরেকটি চট্টগ্রামে ৫০০–৭০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল এবং একটি ১০০ শয্যার রিহ্যাবিলিটেশন হাসপাতাল ঢাকার ধামরাইয়ে নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু দক্ষিণাঞ্চল? এত বড় একটি জনপদের কোথাও কোনো হাসপাতালের নাম নেই। অথচ বরিশাল বিভাগে প্রায় এক কোটি মানুষ বসবাস করেন। এখানকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদগুলোর মধ্যে একটি। এমন অবস্থায় বরিশালে চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের একটি শাখা স্থাপন সময়োপযোগী ও জরুরি একটি পদক্ষেপ।
দক্ষিণাঞ্চল মানেই বঞ্চনা:- নলছিটি সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মাহমুদা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দক্ষিণাঞ্চল মানেই বঞ্চনা—বরিশালের প্রতি বৈষম্য কতদিন চলবে?” তার কথার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ জমে আছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, অবকাঠামো—সব ক্ষেত্রেই এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়ার কারণ একটাই—নীতি নির্ধারণে দক্ষিণাঞ্চলের কণ্ঠস্বর নেই।
স্বাস্থ্য খাতেই যদি নজর দিই, দেখা যায় বরিশালে একমাত্র শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এটি বছরের পর বছর ধরে অবকাঠামো ও জনবল সংকটে ভুগছে। নেই আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা, নেই হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। এমনকি উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেবাও সুলভ নয়। ফলে সাধারণ রোগ থেকে শুরু করে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঢাকামুখী হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। এতে সময় ও খরচ—দুটিই বাড়ে, এবং অনেক সময় জীবনও হুমকির মুখে পড়ে।
ঢাকামুখী চাপ কমাতে বরিশালকে গুরুত্ব দিন:-
ঢাকায় ইতোমধ্যে একটি চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল রয়েছে, যা উন্নত চিকিৎসা সেবার একটি মডেল হয়ে উঠেছে। বরিশালে একই ধরনের একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হলে শুধু বরিশাল নয়, আশেপাশের আরও অন্তত ১০–১৭টি জেলার মানুষ এতে উপকৃত হবে। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ নদীবেষ্টিত অসংখ্য দুর্গম এলাকার মানুষ ঢাকার পরিবর্তে বরিশালেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে পারবেন।
এছাড়া বরিশাল ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু। বরিশাল থেকে নদীপথ, সড়কপথ ও ভবিষ্যতে সম্ভাব্য রেলপথ ব্যবহার করে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সম্ভব। বরিশাল হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা হাব।
অবকাঠামোগত প্রস্তুতিও রয়েছে:- সরকার চাইলে বরিশালে দ্রুত জমি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব। শহরের আশপাশে পর্যাপ্ত সরকারি জমি রয়েছে যেখানে চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতে পারে। বরিশাল-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, বরিশাল বিমানবন্দর এবং উন্নত নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এটি একটি আদর্শ স্থান।
উন্নয়নের বৈষম্য: কখন শেষ হবে? পূর্ববর্তী সরকারের সময় বরিশাল-ভাঙ্গা ৬ লেন এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছিল। এটি বাস্তবায়িত হলে বরিশাল বিভাগ দেশের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে পারত। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেই প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য বিভাগে একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে—মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, উত্তরা ক্যান্সার হাসপাতাল, ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ ইত্যাদি। দক্ষিণাঞ্চল বরাবরই এসব উন্নয়নের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শিক্ষা ও গবেষণায়ও পিছিয়ে বরিশাল:- শুধু স্বাস্থ্য নয়, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বরিশাল অবহেলিত। এখানে কোনো পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। নেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এসব প্রতিষ্ঠান জরুরি, যা দক্ষিণাঞ্চলে এখনো বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি।
একটি হাসপাতাল হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ:- চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল শুধুই একটি হাসপাতাল নয়, এটি আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের প্রতীক, উন্নয়নের মডেল। বরিশালে এর একটি শাখা হলে তা শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, বরিশালের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখবে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হয়ে উঠবে পর্যটন কেন্দ্র, বাড়বে কর্মসংস্থান, গড়ে উঠবে সহায়ক অবকাঠামো।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম এর মতে, বরিশালে এই হাসপাতাল হলে দক্ষিণাঞ্চলের চিকিৎসা, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক নতুন গতিপথ পাবে। বরিশাল হয়ে উঠতে পারে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু।
দক্ষিণাঞ্চল আর নীরব থাকবে না:- দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন প্রশ্ন তোলে—আমরা কি বাংলাদেশের বাইরে? কেন আমাদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় কোনো বরাদ্দ থাকে না? কেন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামোতে আমরা পিছিয়ে? সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমাদের কণ্ঠস্বর নেই বলেই কি এই অবহেলা? এসব প্রশ্নের উত্তর এখন সময়ের দাবি।
আমাদের দাবি:- ১. বরিশালে চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল স্থাপন।
২. বরিশাল-ভাঙ্গা ৬ লেন এক্সপ্রেসওয়ে পুনরায় চালু।
৩. বরিশালে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার ও হৃদরোগ ইনস্টিটিউট।
৪. বরিশালে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।
৫. বরিশালের পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিনিধিত্ব।
৬. ফরিদপুর–বরিশাল–কুয়াকাটা রেল প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন।
পরিশেষে, বাংলাদেশের একটি টেকসই, সমতাভিত্তিক ও মানবিক উন্নয়ন কাঠামো গঠনের জন্য বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হবে। একটি চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল বরিশালে স্থাপন করা হলে তা হবে একটি প্রতীকী নয়, কার্যকর পদক্ষেপ। এটি শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, উন্নয়ন ও সমতার বার্তা বহন করবে।
এখন সময় এসেছে, দক্ষিণাঞ্চলের কণ্ঠ আর নিস্তব্ধ থাকবে না। আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ ।
লেখক: মুহাম্মদ ইমাদুল হক (প্রিন্স)
