বিতর্কিত নির্বাচনের দায় নিতে অস্বীকৃতি: আদালতে সাবেক সিইসি নুরুল হুদা, চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও সংবিধান পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে সোমবার (২৩ জুন) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে বিচারকের সামনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘কমিশনের কার্যক্রম বিতর্কিত হলেও তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করা যায় না।’
বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ হেফাজতে আদালতে আনা হয় সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারকে। পরে বিকেল ৪টা ৮ মিনিটে আদালতের এজলাসে তোলা হয় তাকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার আদালতে নুরুল হুদার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরে জানায়, “নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছেন তিনি। জনগণের ক্ষোভে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার মূল নায়ক হিসেবে তার দায় অস্বীকারের সুযোগ নেই।”
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে উঠে আসে, “নুরুল হুদা ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন, ডিসি-ইউএনওদের দিয়ে রাতে ভোট দিয়েছেন। বিরিয়ানি ও টাকার বিনিময়ে ফলাফল বদলে দিয়েছেন। অথচ এখন তিনি বলেছেন নির্বাচন কমিশন দায়ী নয়—এটা নির্লজ্জতার চরম প্রকাশ।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম সজিব রিমান্ড বাতিল ও জামিনের আবেদন করেন। তিনি যুক্তি দেন, “আসামির বিরুদ্ধে আনা সবগুলো ধারা জামিনযোগ্য। অথচ প্রসিকিউশন আইনের বাইরে গিয়ে রিমান্ড দাবি করছে। তাছাড়া মামলার এজাহার ত্রুটিপূর্ণ এবং আইনগতভাবে এটি টিকবে না।”
আদালত শুনানির এক পর্যায়ে নুরুল হুদার কাছে জানতে চান, তিনি দায়িত্ব পালনের সময় শপথ ভঙ্গ করেছেন কি না। জবাবে তিনি ‘না’ বলেন এবং যুক্তি দেন, “কমিশনের ৫ সদস্য এবং তাদের সহযোগী ১৬ লাখ লোকের সমন্বয়ে নির্বাচন পরিচালিত হয়। ঢাকায় বসে নির্বাচনের প্রতিটি কেন্দ্র মনিটর করা সম্ভব নয়। নির্বাচন হয়ে গেলে দায় গিয়ে পড়ে হাইকোর্টের ওপর।”
শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়, হট্টগোল সৃষ্টি হয় এজলাসে। পক্ষে-বিপক্ষে দীর্ঘ প্রায় আধা ঘণ্টার শুনানি শেষে বিচারক চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে, রোববার (২২ জুন) রাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একের পর এক নির্বাচন পরিচালনা করেন। বিশেষ করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন পরিকল্পিতভাবে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার, গুম ও ভোট কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে ভোটাধিকার হরণ করে।
এছাড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, “ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূরণ করে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন কমিশন পুরো প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করেছে।”
অভিযোগে আরও বলা হয়, “নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। অথচ কমিশন নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে একটি অবৈধ সরকার গঠনে সহযোগিতা করেছে। নুরুল হুদা ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন।”
আসামিপক্ষ আদালতে দাবি করে, কে এম নুরুল হুদা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরে সাব-কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছেন এবং পটুয়াখালী জেলা হানাদার মুক্ত করেছেন। তারা বলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এমনভাবে গণপিটুনি ও হেয় করা দেশের জন্য লজ্জাজনক।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সম্মান নিয়ে কেউ যদি জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে, তাহলে সে সম্মান তার থাকে না। বরং এটি একটি মুখোশ, যার আড়ালে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে।”
