দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের প্রস্তুতির জন্য করণীয়

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষা ২৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীদের প্রস্তুতির সুবিধার জন্য লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির পরামর্শ প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রথম পর্বে থাকছে দেওয়ানি কার্যবিধি আইন ১৯০৮ বিষয়ে প্রস্তুতির পরামর্শ। পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী রিয়াজুর রহমান।
আইনজীবী তালিকাভুক্তির এবারের এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। তাই লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নও সহজ হবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। কৌশলী ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে প্রস্তুতি নিতে না পারলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কিছুটা কঠিন।
লিখিত পরীক্ষায় দেওয়ানি কার্যবিধি থেকে দুটি এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন থেকে একটি প্রশ্ন আসে। তিনটি প্রশ্ন মিলিয়ে একটি গ্রুপ করা হয়। এই গ্রুপ থেকে কমপক্ষে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের নম্বর ১৫। কেউ ইচ্ছা করলে দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ানি কার্যবিধি থেকেও দিতে পারেন। একটি দেওয়ানি কার্যবিধি অপরটি সুনির্দিষ্ট আইন থেকেও উত্তর দেওয়া যাবে।
সিলেবাসের সবচেয়ে কঠিন, বড় এবং জটিল আইন হচ্ছে দেওয়ানি কার্যবিধি। তবে এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা, আদেশ ও বিধিগুলোকে সরলীকরণভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক উপায়ে লেখার অভ্যাস করতে হবে। বিশেষ করে এমসিকিউয়ের জন্য যেসব বিষয় পড়েছেন, সেসব বিষয় আবার পড়তে হবে।
গুরত্বপূর্ণ বিষয়গুলো
ডিক্রি, রায় এবং আদেশের মধ্যে পার্থক্য, দেওয়ানি মোকদ্দমার পর্যায়, দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার, কখন আদালতের এখতিয়ার বিষয়ে আপত্তি করা যায়, রেস সাবজুডিস ও রেস জুডিকাটার মধ্যে পার্থক্য, কোন কোন কারণে আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা স্থগিত রাখা যায়, রেস জুডিকাটা ও স্টোপেলের মধ্যে পার্থক্য কী, এনালোগাস বা একত্রে বিচার বলতে কী বোঝায়, মামলায় কারা বাদী-বিবাদী হতে পারবে, অপসংযোগ বা অ-সংযুক্ত সম্পর্কে কখন আপত্তি তোলা যায়, প্রতিনিধিত্বমূলক মামলা কাকে বলে, সমন জারি (নতুন সংযোজিত আইনের বিধানগুলোও পড়তে হবে), প্লিডিংসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কখন কোন কোন কারণে আরজি ও জবাব সংশোধন করা যায়, লিখিত জবাবের আবশ্যকীয় উপাদান কী কী, আরজি প্রত্যাখানের দরখাস্ত মঞ্জুর বা না-মঞ্জুরের আদেশের ফলাফল, আরবিট্রেশন–সংক্রান্ত অধ্যায়, হাজির-গরহাজির, স্বীকার ও বিচার্য বিষয়, মোকদ্দমা একতরফাভাবে নিস্পত্তি হলে করণীয় কী, রায়, ডিক্রি (নতুন সংযোজিত আইনের বিধানগুলোও পড়তে হবে), অ্যাবেটমেন্ট এবং মামলা প্রত্যাহার–সংক্রান্ত বিষয়গুলো বারবার পড়তে হবে।
অনেক সময় বড় একটি প্রশ্ন না এসে একটি অনুচ্ছেদের হ্যান্ডলে তিনটি বা চারটি ছোট ছোট প্রশ্ন জুড়ে দিতেও পারে। এ ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদের বক্তব্য, অনুচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের যেসব ধারা সম্পর্কিত রয়েছে, সেগুলো অনুধাবন করে লিখতে হবে। এ ছাড়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, আপিল, রিভিউ, রিভিশন, মোকদ্দমা খারিজ, মোকদ্দমা পুনর্বহাল, মোকদ্দমা মুলতবি, আপিলে মুলতবি, আপিল খারিজের প্রতিকার এবং কমিশন ইস্যুর ক্ষমতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একই বিষয়ে নানাভাবে প্রশ্ন আসতে পারে।
পরীক্ষায় মাঝেমধ্যেই শর্ট নোট বা টিকা আসে। এ ধরনের প্রশ্নের জন্য আদেশ এবং ডিক্রি, মিনস প্রফিট বা অন্তর্বর্তীকালীন মুনাফা, সাব্যস্ত দেনাদার, বৈধ প্রতিনিধি, কজ অব অ্যাকশন, রেস জুডিকাটা, বিকল্প সমনজারি, প্লিডিং, প্লিডিং সংশোধন, সেট অফ, বিচার্য বিষয়, স্থানীয় তদন্ত, রিসিভার, বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খুঁটিনাটি পড়তে পারেন।
যেভাবে লিখতে হবে
প্রশ্নের ধরন অনুসারে উত্তর লিখতে হবে। সমস্যামূলক প্রশ্ন হলে প্রথমেই সমস্যাটি কোন আইনের কোন ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেটি বুঝতে হবে। পরে আইনের ধারাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সমস্যার সমাধান লিখতে হবে। রচনামূলক প্রশ্ন হলে বিষয়বস্তুর সংজ্ঞা, সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা, কেস রেফারেন্স এবং উদাহরণ দিয়ে লিখতে হবে। এতে নম্বর তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়।
ধরা যাক, প্রশ্নে রেস জুডিকাটা নিয়ে একটি টিকা এল। উত্তরে লিখতে পারেন লাতিন শব্দ রেস অর্থ বিষয় এবং জুডিকাটা অর্থ হলো নিষ্পত্তিকৃত অর্থাৎ রেস জুডিকাটা অর্থ হচ্ছে আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত কোনো বিষয়। দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ১১ ধারায় রেস জুডিকাটা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মামলাটি এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত কর্তৃক একবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, পরে যদি পুনরায় একই বিচার্য বিষয় নিয়ে এবং একই পক্ষসমূহ মামলা করে, তাহলে আদালত মামলাটি বিচার করবে না—এই নীতিটি হচ্ছে রেস জুডিকাটা।
আলম বনাম সলিমুল্লাহ চৌধুরী, ১০ এম এল আর (এডি) ৯০ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন যে দেওয়ানি কার্যবিধির ১১ ধারা একই বিষয়ে দুবার বিচার করতে বাধা দেয়। তাই একবার চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিকৃত কোনো মামলা পুনরায় বা দ্বিতীয়বার বিচার করা যায় না। একই বিষয়ে দ্বিতীয়বার বিচারে বাধা দেওয়ার নীতিই হলো রেস জুডিকাটা।
উদাহরণ, ক, খ–এর বিরুদ্ধে স্বত্ব ঘোষণার মামলা করেন। আদালত মামলাটি খ–এর পক্ষে রায় দেন। এখন ক যদি উক্ত বিষয়ে পুনরায় মামলা করেন, তাহলে পরে দায়েরকৃত মোকদ্দমাটির ক্ষেত্রে রেস জুডিকাটা নীতি প্রয়োগ হবে এবং মোকদ্দমাটি খারিজ হবে।
অপর দিকে মুসাবিদা অংশে প্রথমেই দেখতে হবে, কোন বিষয়ে মুসাবিদা করতে বলা হয়েছে। আরজি হলে আরজির ফরম্যাট, জবাব হলে জবাবের ফরম্যাট কিংবা কোনো দরখাস্ত লিখতে বললে দরখাস্তের ফরম্যাটে লিখতে হবে। দেওয়ানি মুসাবিদায় লক্ষ রাখতে হবে আরজি ও জবাবে সত্যপাঠ হয়। বাকি সব দরখাস্তে হলফনামা দিতে হয়। মুসাবিদা অংশে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয় আদালতের নাম। প্রশ্নের মধ্যে যদি কোনো আর্থিক এখতিয়ারের কথা বলা থাকে, তাহলে দেওয়ানি আদালতের আর্থিক এখতিয়ার অনুসারে মুসাবিদার সময় আদালতের নাম উল্লেখ করতে হবে। এ জন্য বিগত দিনের প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তরগুলো ভালো করে পড়তে হবে। বাসায় উত্তর লেখার অনুশীলন করতে হবে। অনেকেই আছেন, ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও পরীক্ষার হলে প্রশ্ন বুঝতে না পেরে অকৃতকার্য হয়েছেন। ফলে যত বেশি প্রশ্ন পড়বেন, তত দ্রুত প্রশ্নের ভাষা বুঝবেন। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার হলে সময় নির্ধারিত। এ সময়ের মধ্যেই আপনাকে প্রশ্ন বুঝে, কী লিখবেন, সেটা নির্ধারণ করে উত্তর লিখতে হবে।
