জোহরান মামদানি: নিউইয়র্কে মুসলিম মেয়র প্রার্থী, হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেটে

আগামী নভেম্বরের নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হলে জোহরান মামদানি হবেন শহরটির প্রথম মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র। তবে এই ঐতিহাসিক সম্ভাবনা যেমন আলোড়ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে, তেমনি উদ্বেগেরও জন্ম দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ও প্রবাসী ভারতীয়দের একাংশের মধ্যে।
৩৩ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গত ২৪ জুন দলীয় প্রাথমিক বাছাইয়ে জয়ী হওয়ার পর থেকেই হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জোহরান মামদানি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে তার স্পষ্ট অবস্থানের কারণেই দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন।
জোহরানের বিরুদ্ধে চলমান প্রচারনায় তার মুসলিম পরিচয়কেই মূল ইস্যু করে তোলা হয়েছে। কেউ তাকে "জিহাদি" বলছেন, কেউ বা "ইসলামপন্থি" কিংবা "হিন্দুবিরোধী"। বিজেপি-সমর্থক ভারতীয় মিডিয়ায় তাকে ‘ভারতবিরোধী’ তকমা দেওয়া হচ্ছে এবং অভিযোগ করা হচ্ছে, তিনি 'চরমপন্থী' গোষ্ঠী থেকে অর্থ গ্রহণ করেন।
‘আজকাল’ নামের একটি চ্যানেল তো এক ভিডিও প্রতিবেদনে হিজাব পরা মুসলিম নারীদের চিত্র দেখিয়ে নিউইয়র্কে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে সরাসরি শঙ্কা প্রকাশ করে। নিউ জার্সিভিত্তিক সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুমো’ তো আকাশে ব্যানার ওড়ায়—"নিউইয়র্ক শহরকে বৈশ্বিক ইনতিফাদা থেকে রক্ষা করুন। মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করুন"।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাট দাঙ্গা এবং ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরোধিতায় জোহরান বরাবরই সোচ্চার। তিনি ২০২০ সালে টাইমস স্কয়ারে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে মোদির সফরের আগে তিনি ভারতের কারাবন্দি মানবাধিকার কর্মী ওমর খালিদের লেখা পাঠ করেন এক জনসভায়।
এক সাক্ষাৎকারে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়—মোদির সঙ্গে দেখা করবেন কি না, জবাবে জোহরান বলেন, “না। কারণ তিনি যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত।” এই বক্তব্যের পর পুরনো এক ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে তিনি গুজরাট দাঙ্গায় মোদির ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন।
‘ইন্ডিয়া টুডে’ এক প্রতিবেদনে এই বক্তব্যকে "ডাঁহা মিথ্যা" আখ্যা দিয়ে দাবি করে—জোহরান গুজরাটের ৬০ লাখ মুসলমানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভী সামাজিক মাধ্যমে লিখেন, "জোহরানের মতো বন্ধু থাকলে ভারতের শত্রুর প্রয়োজন নেই।"
তবে এইসব সমালোচনার জবাবে জোহরান নিজের গুজরাটি মুসলমান ঐতিহ্য তুলে ধরে বলেন, “২০০২ সালে আমরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই। অনেকে বিশ্বাসই করেন না আমরা এখনো বেঁচে আছি।”
সান্তা ক্লারার অধ্যাপক রোহিত চোপড়ার মতে, "জোহরান ভয়হীনভাবে মোদির সমালোচনা করায় উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ক্ষোভের শিকার।" তিনি বলেন, “আমেরিকায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যখন ক্যাব চালান, থালা মাজেন, তখন উচ্চবর্ণের অভিজাত হিন্দুরা তাদের ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে চান না। অথচ জোহরানের মতো মুসলমান প্রার্থী মোদির সমালোচনা করলেই তারা একজোট হয়ে বিরোধিতা করে বসেন।”
সমালোচনার ঝড় সত্ত্বেও জোহরান মামদানি তার রাজনৈতিক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন এবং উল্লেখযোগ্য সমর্থনও পাচ্ছেন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অরবিন্দ রাজগোপাল বলেন, “জোহরান শুধু ইংরেজি নয়, হিন্দি, উর্দু, বাংলাও বলেন। এমন ভাষাগত দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক সংযোগ তাকে নিউইয়র্কের দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।”
জোহরান দুর্গা মন্দির, নেপালি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, গায়ানি ও ট্রিনিদাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। দীপাবলীর ছুটি ঘোষণার জন্য তিনি আইন প্রস্তাব করেছেন।
নভেম্বরের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো। যদিও দু’জনই ডেমোক্র্যাট হলেও এবার তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন।
পিউ রিসার্চের তথ্য মতে, নিউইয়র্কে প্রায় ৭ লাখ ১০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাস করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই জনগোষ্ঠীর ভোট গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা এককভাবে কোনো প্রার্থীকে জিতিয়ে দিতে যথেষ্ট নয়। বরং জোহরানের মাল্টিকালচারাল সংযোগ ও প্রগতিশীল অবস্থানই তাকে এগিয়ে রাখছে।
সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সত্ত্বেও জোহরান মামদানি তার রাজনৈতিক অবস্থানে অনড় রয়েছেন। মুসলমান, প্রগতিশীল এবং নির্ভীক—এই পরিচয়ই তাকে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের নতুন ধরনের প্রার্থী করে তুলেছে। তিনি জিতলে তা হবে কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক নতুন ইতিহাস।