বাড়ি করতে বেদখল জমি উদ্ধার করে চান শহীদ মিরাজের মা

মাথা গোঁজর ঠাঁই করতে কষ্টার্জিত অর্থে ক্রয় করেও বেদখলে থাকা ৫শতাংশ জমি উদ্ধার করে চান জুলাই আন্দোলনে শহীদ মিরাজুল ইসলাম মিরাজের মা মোহছেনা বেগম। এ জমি টুকু উদ্ধার করতে পুলিশ কেচ করেও যখন ব্যর্থ হয়। তখন মেধাবী ছাত্র মিরাজ মাকে কথা দিয়েছিল, "বড় চাকুরি করে একদিন এ জমি দখলে নিয়ে মস্তবড় একটা বাড়ি করব।" শহীদ ছেলের স্বপ্ন পুরনে দেশবাসীর কাছে আকুতি শহীদ জননীর।
উপার্জনক্ষম সন্তান ও স্বামীকে হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে এ শহীদ পরিবারটি। প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি আওড়ানো হলেও বাস্তবে শুন্য থলিতে পড়ে হতাশায় দিন কাটছে তাদের ৪ সদস্যের সংসার।
শহীদ মিরাজুল ইসলাম মিরাজ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া গ্রামের আনছার খাঁর পুকুরপাড় এলাকার মৃত আব্দুস ছালামের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিরাজ সবার বড়।
গত বছর জুলাই আন্দোলনে ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানার সামনে মাছের আড়ত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৮ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মিরাজের মৃত্যু হয়।
সরেজমিনে শহীদ মেরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চাচা কালাম মিয়ার জমিতে একটা লম্বা টিনসেট ঘরের মাঝে পাটিশন দিয়ে তৈরি করা দুইটি কক্ষ। সেই দুই কক্ষ নিয়ে শহীদ মিরাজের বাড়ি। পাশের টিনে ঘেরা বার্থরুম। অপর প্রান্তে টিনের ছায়লায় রান্না করেন শহীদ জননী মোহছেনা বেগম। ডোরা নদীর পাড় ঘেঁষা বাড়ি তাদের। বাড়ি যাবার রাস্তাটি সাম্প্রতিক সময় সরকারী ভাবে করে দেয়া হয়েছে।
মিরাজের পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করে সিএনজি চালক বাবার সঙ্গে ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় পাড়ি জমান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকত মিরাজের পুরো পরিবার। ঢাকা দনিয়া মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন মিরাজ। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন মিরাজ। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসার চলতো মিরাজের আয়ে।
গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে অন্যদের মতো যাত্রাবাড়ি থানার সামনে মাছের আড়ত এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয় মিরাজ। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত মিরাজকে স্থানীয়রা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রপাচার করে গুলি বের করা হয়। ৮ আগস্ট চিকিৎসাধিন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
মিরাজের মৃত্যুতে নিভে যায় তাদের সংসারের আলো। উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পুরো পরিবার। কষ্টর্জিত টাকায় কেনা ৫ শতাংশ জমিতে বাড়ি করার স্বপ্নে ঢাকায় পাড়ি জমায় মিরাজের পরিবার। তা মাঝপথে নিভে যায়। জমিটুকুও হয়ে যায় বেদখল। দলিল দিলেও দখল দেননি দাতা প্রতিবেশি দুলাল। সে জমি দখলে নিতে থানা পুলিশ করেও সুফল মেলেনি। হারতে হয়েছে টাকার কাছে। পড়ালেখা শেষে চাকুরি করে বেদখলিয় জমি উদ্ধার করে বাড়ি করেই তবে ঢাকা থেকে ফেরার স্বপ্ন ছিল মিরাজের।
ছেলের মৃত্যুর শোকে অসুস্থ্য বাবা আব্দুস ছালাম বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে সরকারী ভাবে ৫ লাখ টাকা পান। সে টাকায় মহিষখোচা বাজারে একটা খাস জমির ব্যবস্থা করে দেয় বিএনপি'র নেতারা। সেই জমিতে দোকান করে সরকারী পাবে পাওয়া ৫ লাখ টাকায় দোকান ঘর করে ব্যবসা শুরু করেন আব্দুস ছালাম। হঠাৎ তিনিও স্টক করে মারা যান। আবারো অনামিশার ঘোর অন্ধকারে ডুবে যায় মিরাজের পরিবার।
বড় ছেলে আর স্বামীকে হারিয়ে নির্বিকার শহীদ জননী মোহছেনা বেগম। বাধ্য হয়ে সংসারের খাদ্য যোগাতে শহীদ মিরাজের স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই মেজবাউল ও সিরাজুল স্কুলের ফাঁকে দোকান করেছে। স্কুলে গেলে বন্ধ হয় দোকান আর দোকান চালু রাখলে বন্ধ হয় স্কুল যাওয়া।
শহীদ মিরাজের দাদি সালমা খাতুন বলেন, আগে নাতি মিরাজ আমার ওষুধসহ চিকিৎসার দেখভাল করত। তার মত্যুর পরে ছেলে ছালাম ওষুধের ব্যবস্থা করত। এখন ছোট ছোট দুই নাতি স্কুলের ফাকে দোকান করে যা আয় করছে তা দিয়ে কোন রকম খাবার জুটছে।
শহীদ মিরাজের ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাহিরে অনেক প্রোপাগন্ডা ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে শহীদ পরিবারকে কোটি কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। বাস্তবে প্রথম দফয় ৫ লাখ টাকা আর বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা ছাড়া কিছুই পাইনি। আমাদের ক্রয় করা জমি বেদখল থেকেও উদ্ধার করে দিতে পারেনি সরকারী কর্মকর্তারা। তারা শুধু বুলি আওড়ায়। ভাইকে কারা গুলি করলো? তার সঠিকটা জানতে চাই। চাই দ্রুত খুনিদের বিচার। যারা শহীদ পরিবার নিয়ে মিথ্যে প্রপাগন্ডা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
মিরাজের মা মোহছেনা বেগম বলেন, বাড়ির জন্য কেনা জমিটুকু দখল পেতে থানা পুলিশ করেছিল মিরাজ আর তার বাবা। কিন্তু টাকার কাছে আমরা হেরে যাই। কথা শুনেনি হাসিনা সরকারের পুলিশ। তখন মিরাজ বলছিল, " মা চিন্তা করো না আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকুরি করে এ জমি উদ্ধার করে বাড়ি করে দিবো। " আমার ছেলের এ স্বপ্ন আজও পুরন করতে পারিনি। সরকারী লোকদের বলেছি তারাও আশ্বাস দিয়ে চলে যান। দ্বিতীয় বার আর আসে না।
তিনি বলেন, বাজারের সরকারী একটু জমি দখল দিয়েছে বিএনপি। সে জায়গায় দোকান ঘর নির্মান করে পসরা সাজাতে সরকারী ভাবে পাওয়া ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সরকারী জায়গা দখল দিয়ে বিএনপি প্রচার করলো আমাদের দোকান সাজিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে শুধু জামায়াত নেতারা ফোন করে খবর নেন। তাছাড়া আর কেউ খবর নেয় নি। ছেলে ও স্বামীকে হারানো আমি কেমন আছি?। স্বামী হারালে সন্তানকে নিয়ে শোক হালকা করা যায়। আমি আদরের ছেলের কয়েক মাসের ব্যবধানে স্বামীকে হারিয়েছি। আমার মত দুঃখি বুঝি নেই কেউ। এই বলে কান্না শুরু করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, কোন নাগরিকের জমি জবর দখলের কোন সুযোগ নেই। সেখানে জুলাই আন্দোলনের শহীদ পরিবারের হলে তো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব পাবে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সাথে কথা বলে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করবে এনসিপি।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিধান কান্তি হালদার বলেন, শহীদ পরিবারের জমি বেদখলের বিষয়টি আমার যোগদানের ৩ মাসে কেউ বিষয়টি জানায় নিখোঁজ খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
