ছাত্রীকে পৃথিবীর সব সুখ দিতে চাওয়া নোবিপ্রবির শিক্ষককে চাকুরী থেকে অপসারণ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবির) এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী অধ্যাপক এইচ. এম. মোস্তাফিজুর রহমানকে চাকুরি থেকে অপসারণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সোমবার ( ২৬ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার তামজিদ হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
অফিস আদেশে বলা হয়, উপযুক্ত বিষয়ে আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের (বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) শিক্ষার্থী জনাব ফারজানা রহমান (শিক্ষাবর্ষ-২০১৯-২০, রোলঃ BFH2016035F) এর লিখিত অভিযোগ এবং অভিযোগের সাথে দাখিলকৃত প্রমাণাদির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ, নোবিপ্রবি/রেজি/সং-শা/কাঃদঃনোঃ/২০২৫/১৮৩৪২ তারিখঃ ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ স্মারকের আলোকে প্রেরিত কারণ দর্শানো নোটিশ, উক্ত কারণ দর্শানো নোটিশের প্রেক্ষিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে আপনার প্রেরিত জবাব, নোবিপ্রবি/রেজি/সং-শা/অফিস আদেশ/২০২৫/১৮৬৪৫ তারিখঃ ০৮ এপ্রিল, ২০২৫ স্মারকের আলোকে গঠিত আইনানুগ মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ পর্যালোচনাপূর্বক দেখা যায় আপনার বিরুদ্ধে আনীত অসদাচরণ, চাকুরী শৃঙ্খলার জন্য হানিকর আচরণ এবং নৈতিক জ্বলন সংক্রান্ত অভিযোগসমূহ সুস্পষ্ট এবং সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এমতাবস্থায়, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৫ তারিখ প্রেরিত কারণ দর্শানো নোটিশের প্রেক্ষিতে আপনার প্রেরিত জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায়, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সকল কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত মে ১৭, ২০২৫ তারিখ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের ৬৫ তম সভার আলোচ্যসূচী-১৯(০১) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ দাখিলকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি আইনানুগভাবে সুস্পষ্ট এবং কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়া প্রমাণিত হওয়ায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০১ এর ধারা ৪৭ (৮) এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ০৩ (খ) অনুযায়ী আপনাকে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের (বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) সহকারী অধ্যাপক (সাময়িক বরখাস্তকৃত) পদ হইতে অপসারণ করা হলো।
এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী অধ্যাপক এইচ. এম. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই শিক্ষককে কেন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, তা আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিতভাবে বলার জন্য শোকজ পাঠান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ওই শিক্ষার্থী অভিযোগে বলেন, ‘শিক্ষক এইচ. এম. মোস্তাফিজুর রহমান আমার মায়ের নম্বরে ফোন দিয়ে বলেন- পৃথিবীর সব সুখ আমি আপনার মেয়েকে দেব, কোনো স্বামী এই পৃথিবীতে তা দিতে পারবে কিনা, আমি জানি না।’
নোটিশে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘অভিযুক্ত শিক্ষক এইচ. এম. মোস্তাফিজুর রহমান অভিযোগকারী শিক্ষার্থীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে প্রতারণা করে অসদাচরণ করেছেন। অভিযোগকারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে অবস্থিত শিক্ষক এপার্টমেন্ট 'শঙ্খচিল' এ অনৈতিক উদ্দেশ্যে অবস্থান করে অসদাচরণ এবং নৈতিক স্খলন ঘটিয়েছেন। তিনি বিয়ে করার দুই দিন আগে (৯ অক্টোবর, ২০২৪) প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে নৈতিকস্খলন ঘটিয়েছেন।’
গত বছরের ২৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর অভিযোগপত্রে ওই ছাত্রী জানান, ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৪ মার্চ ২০২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন মাস ওই শিক্ষক আমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক জড়ানোর জন্য তাকে মানসিক অত্যাচার করেন। পরবর্তীতে সে ওই শিক্ষককে অনলাইনে ব্লক দেয়। পরে ওই শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে কল দিয়ে ওই শিক্ষক বলেতেন- ওই ছাত্রীকে পেলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগপত্রে লিখেন, ‘এমন করে করে তিনি আমাকে ফাঁদে ফেলতেন এবং মানসিকভাবে আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি। একটা পর্যায়ে ভাবতে থাকি আমার কারণে একটা মানুষ এতো কষ্ট পাচ্ছে। ২০২৩ সালের ১১ মার্চ তিনি পিএইচডি পড়া ছেড়ে আমার কারণে দেশে চলে আসেন এবং বলেন আমার আশেপাশে থাকলেই তিনি ভালো থাকবেন।’
তিনি আরও লিখেন, ‘আমার একাডেমিক লাইফে ক্ষতির সম্ভাবনা, মোস্তাফিজুর রহমানের প্রতিনিয়ত কান্নাকাটি এবং নানান বিষয়ে ডিপ্রেশনে থাকার কারণে আমি তার সঙ্গে সম্পর্কে যেতে রাজি হই। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক চলতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মে। এর মধ্যে কয়েকদফা তিনি আমাকে একা একা বিয়ে করে ফেলার কথা বলেন কিন্তু আমি বলেছি ফ্যামিলিকে জানাও তারপর বিয়ে করব। ২০২৪ সালের কুরবানি ঈদের সময় থেকে তিনি পরিবারে জানান এবং তার ভাষ্যমতে তার পরিবার রাজি হয় না।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগে বলেন, ‘১১ অক্টোবর শুক্রবার তিনি আমাকে বিয়ে করবেন বলে ঢাকা যেতে বলেন। আমি তার কথা বিশ্বাস করে ঢাকা যাই। কিন্তু তিনি নানা তাল বাহানা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার বাবা অসুস্থ বলে আমার থেকে তড়িঘড়ি বাড়ি যাবে বলে বিদায় নেন। আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরে কপালে চুম্বন করে বলেন- আমি আমার বাবাকে দেখে এসে তোমাকে বিয়ে করবো ময়না, আমার অপেক্ষা করিও, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব পারিবারিক বিয়েটা ভাঙানোর, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
শিক্ষার্থী অভিযোগে আরও বলেন, ‘পরবর্তীতে জানতে পারি তার বাবা অসুস্থ হয়নি। বরং ১৩ অক্টোবর রবিবার চট্টগ্রামে তিনি অন্য একজনকে বিয়ে করেন যার সঙ্গে তার ৩ মাস আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল।’
এর আগে নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই ঘটনায় গত বছরের ৩০ অক্টোবর অভিযুক্ত শিক্ষক এইচ. এম. মোস্তাফিজুর রহমানকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি চাকুরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
