সন্তানকে অতিমাত্রায় শাসন করে তার বিপদ বাড়াচ্ছেন না তো

এ কথা সবাই মানবেন, এখনকার শিশুরা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট, বেশি বুদ্ধিমান। আমাদের শৈশব-কৈশোরের তুলনায় তো বটেই। ছোটবেলায় আমরা ইন্টারনেট পাইনি। এত সব টিভি চ্যানেল আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। ফলে আমাদের তুলনায় তাদের পৃথিবীটা বড়। তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা আর আত্মসম্মানবোধও অনেক বেশি।
বেশি শাসনে যা হতে পারে
আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন কোনো ভুল করলে মা-বাবা, বড় ভাই-বোনের কাছে বকা বা মার খেয়েছি। আবার মন খারাপ করে চোখের পানি মুছে নিজেরাই স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। কিন্তু এখনকার শিশু-কিশোরদের অতিমাত্রায় বকা বা শাসন করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।
এখনকার অনেক অভিভাবকও অবশ্য সন্তানের খাওয়া, লেখাপাড়া, সৃজনশীল কাজ নিয়ে অতিমাত্রায় শাসন করেন। অনেকের ধারণা, মুঠোফোন, ভিডিও গেম, কার্টুনের যুগে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সবার সামনে বকা দেওয়া যেতেই পারে। বকা দিলে সন্তান মা-বাবার কথা মতো চলবে, ঠিকমতো পড়বে, সঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবার খাবে। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। এই প্রজন্মের শিশুকে নিজের সঙ্গে মেলালে আপনি ভুল করবেন। একদিন বকা বা মার খেয়ে শিশু চুপ থাকতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে থাকলে সন্তান একসময় অতিমাত্রায় বিরক্ত হবে।
গবেষণার তথ্য বলছে, যেসব শিশু অতিমাত্রায় কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয়, তারা পরবর্তী জীবনে বেশি আতঙ্কের মধ্যে থাকে। এ ধরনের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তিক্ততা থেকে এসব শিশু-কিশোর অধিকাংশ সময় পরিবার ছাড়াও অন্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলে।
সন্তান অতিমাত্রায় দুষ্টুমি করলে বা খুব বেশি অবাধ্য হলে, তাকে শাসন করতে হবে। তবে সেটা সব মানুষের সামনে চিৎকার-চেঁচামেচি করে নয়। শিশুকে অপদস্ত করলে ফল ভালো হবে না। শিশুদের আদর করে, বারবার বুঝিয়ে বলতে হবে। যেসব শিশু অভিভাবকের কাছ থেকে নিয়মিত বকা খায়, সেসব শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে, তারা একটুতেই ভয় পায়।
শিশুকে ভয় দেখাবেন না
শিশুকে কোনো কিছু নিয়ে ভয় দেখানো যাবে না। এতে তার মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে
কড়া শাসনে শিশুর ব্যক্তিত্ব যেভাবে বদলে যায়
কড়া শাসনের কারণে শিশুরা বড় হয়ে একা সিদ্ধান্ত নিতে প্রায়ই ভুল করে। আবার বকা খেতে পারে, এই ভয়ে মা-বাবার কাছে তথ্য লুকাতে থাকে, নিয়মিত মিথ্যা বলতে শুরু করে। অনেক পরিবারে দেখা যায়, কিশোর-কিশোরীরা অতিমাত্রায় বকা, তিরস্কার পেতে পেতে অভিভাবকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। অতিরিক্ত শাসনের জন্য একপর্যায়ে বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে সন্তানেরা আর অভিভাবকদের কথা শুনতে চায় না। মা-বাবার সঙ্গে অনেক শিশু-কিশোর মারামারিও করে ফেলে।
শৈশবে অনেক সময় আপনি ভয় দেখিয়ে সন্তানকে হয়তো কখনো কখনো বসিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু কিশোর বয়সে তার বন্ধুবান্ধব হবে। বাসার বাইরে তার নিজের একটা জগৎ তৈরি হবে। এই বন্ধুদের মধ্যে কে আপনার সন্তানের জন্য উপযুক্ত আর কে ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা বুঝে সন্তানকে সাবধান করতে পারেন।
বকাবকি করে বা মেরে শিশুর কাছ থেকে কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়
ভালো বন্ধু হতে চেষ্টা করুন
অনেক অভিভাবক সন্তানকে চাপ দেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজেও পুরস্কার পেতেই হবে। পুরস্কার না পেলে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে সন্তানকে অতিমাত্রায় চাপ দিয়ে আমরা বরং তার স্বাভাবিক সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিই। এ ধরনের আচরণে অনেক সময় বাসার বাকি শিশুরাও ভয় পেয়ে যায়। নিজের সেরাটা প্রকাশ করা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। সন্তানের ভালো ফলের জন্য তাকে বারবার বোঝাতে হবে। তার লেখাপড়াতে সহযোগিতা করতে হবে। কোন বিষয়গুলোতে তার দুর্বলতা, সেটা বুঝে সেইমতো পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো বিষয় শিশুর কাছে কঠিন মনে হলে সেটা ধৈর্য নিয়ে পড়াতে হবে। একটা বিষয় শিশু কোনো এক বেলা পড়তে না চাইলে সেটাতে ছাড় দিন। বরং সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করে সে যে বিষয়টা পড়তে চায়, সেটাই পড়ানো ভালো। সন্তান যদি কোনো এক বেলা পড়ার পরিবর্তে খেলতে চায়, তাহলে তাকে খেলার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, এখনকার সন্তানেরা খেলার মতো মাঠ পায় না। তাদের শৈশবটা কীভাবে রঙিন করা যায়, সেই ভাবনাও রাখতে হবে অভিভাবককে।
তাই সন্তানের কঠোর অভিভাবক না হয়ে বরং ভালো বন্ধু হতে চেষ্টা করুন। বাকি ভালো গুণগুলো সে প্রকৃতি থেকেই শিখে নেবে।
