সবচেয়ে কম বয়সে দেশ চালাচ্ছেন যাঁরা

বিশ্ব রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান এখন আর ব্যতিক্রম নয়। তরুণ নেতাদের কেউ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন, কেউ পরিবারিক সূত্রে ক্ষমতায় এসেছেন, আবার কেউ নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। বয়স ৪০–এর আশপাশে থাকা এমন তরুণ রাষ্ট্রনায়কদের কেউ কেউ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সামলাচ্ছেন, কেউ আবার দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই নেতাদের কেউ ইতিহাসে প্রথম, কেউ সবচেয়ে কমবয়সী প্রেসিডেন্টও। সামরিক, রাজতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উঠে আসা তরুণ এই নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, মোকাবিলা করছেন ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে সবচেয়ে কম বয়সে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ১০ নেতাকে নিয়ে আজকের এ আয়োজন—
১. ইব্রাহিম ত্রাওর
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওর বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী রাষ্ট্রপ্রধান। ৩৬ বছর বয়সী এ সেনা কর্মকর্তা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন।
ত্রাওর যাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, সেই সামরিক নেতা পল-হেনরি সানদাওগো দামিবাও একইভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় ত্রাওরের বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর।
ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতির তীব্র সমালোচক প্রেসিডেন্ট ত্রাওর এখন পশ্চিমা বিশ্বের পরিবর্তে রাশিয়া ও অন্যান্য অ-পশ্চিমা দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছেন।
২ ড্যানিয়েল নোবোয়া
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়া। ২০২৩ সালে ভোটে জিতে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হন, এখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর।
ধনকুবের ফল ব্যবসায়ী আলভারো নোবোয়ার ছেলে ড্যানিয়েল মূলত ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ডে পড়াশোনা শেষে ড্যানিয়েল ২০২১ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন ও পার্লামেন্টের সদস্য হন।
২০২৩ সালে ইকুয়েডরজুড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গুইলার্মো লাসো আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। প্রথম দফা ভোটে কোনো প্রার্থী যথেষ্ট ভোট না পাওয়ায় ভোট দ্বিতীয় দফায় গড়ায়। দ্বিতীয় দফার ভোটে বামপন্থী প্রার্থী লুইসা গনসালেসকে পরাজিত করেন ড্যানিয়েল।
প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়ার জন্য দেশ পরিচালনায় মূল চ্যালেঞ্জ ইকুয়েডরে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া সহিংসতা ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধ। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে তিনি সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
৩ গ্যাব্রিয়েল বোরিক
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক ২০২২ সালের মার্চে ৩৬ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসেন। তাঁর বয়স এখন ৩৮। চিলির ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে কমবয়সী প্রেসিডেন্ট। ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা বোরিক এক দশকের মধ্যে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছেন।
বোরিক ২০১১ সালে চিলির শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ২০১৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক জীবনে সব সময়ই সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানবাধিকার ইস্যুতে সরব ছিলেন তিনি।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বোরিক চিলির কট্টর-ডানপন্থী প্রার্থী হোসে আন্তোনিও কাস্তকে হারান। প্রেসিডেন্ট বোরিক স্বৈরশাসকদের আমলে তৈরি চিলির সংবিধান পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে চান। যদিও নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়ে ২০২২ সালে এ গণভোটে জনগণ তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি, এখনো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
৪. জ্যাকভ মিলাতোভিচ
দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা মিলো জুকানোভিচকে ভোটের লড়াইয়ে পরাজিত করে ২০২৩ সালে মন্টেনেগ্রোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জ্যাকভ মিলাতোভিচ। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৬ বছর।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মন্টেনেগ্রোর অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। দেশে অর্থনীতির ওপর লেখাপড়া করা মিলাতোভিচ পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেন।
জ্যাকভ ‘ইউরোপ নাউ’ আন্দোলনের একজন প্রধান মুখ—যাঁর প্রধান অঙ্গীকার ছিল, অর্থনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতি রোধ। তাঁর বিজয় মন্টেনেগ্রোর রাজনীতিতে তিন দশকের পুরোনো শাসনের অবসান ঘটিয়ে আদর্শগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। জ্যাকভের বয়স এখন ৩৮ বছর।
৫. মোহাম্মদ ইদ্রিস ডেবি
চাদের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইদ্রিস ডেবি ২০২১ সালের এপ্রিলে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বিদ্রোহীরা তাঁর বাবা চাদের দীর্ঘদিনের শাসক ইদ্রিস ডেবিকে হত্যা করলে সেনাবাহিনী মোহাম্মদ ইদ্রিসকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৭ বছর।
মোহাম্মদ ইদ্রিস সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় বলা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ১৮ মাসের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করছেন।
পরে তাঁর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়, যা নিয়ে দেশের ভেতর ও বাইরে অনেক সমালোচনা হয়। ২০২৪ সালে ভোটে জিতে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় বসেন।
একাধিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, বিদ্রোহ ও আঞ্চলিক জটিলতার মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ ডেবিকে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে। তিনি চাদের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার অঙ্গীকার করছেন।
৬. কিম জং-উন
বাবা কিম জং-ইলের মৃত্যুর পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা হন কিম জং-উন। তাঁর জন্ম ১৯৮৪ সালে। তিনি উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের শাসক। কিম জং-উন সুইজারল্যান্ডে লেখাপড়া করেছেন।
কিমের আমলে উত্তর কোরিয়া নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন করেছে। সব হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে পরীক্ষা চালানো কিমকে ২০১৭ সালে জাতিসংঘে দেওয়া এক ভাষণে ‘রকেট ম্যান’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বাকি বিশ্ব থেকে উত্তর কোরিয়াকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন জং-উন। দেশেও তিনি কঠোর নিয়মকানুন প্রচলন করেছেন, জনগণকে যা মানতে বাধ্য করা হয়। কিমের বয়স ৪১ বছর। তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নেতাদের একজন।
৭. ভিয়োসা ওসমানি-সাদরিউ
ভোটে জেতার পর ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল কসোভোর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভিয়োসা ওসমানি-সাদরিউ। তিনি দেশটির ইতিহাসের দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট। ১৯৮২ সালের ১৭ মে জন্মগ্রহণ করা ভিয়োসা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি কসোভোর পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কসোভো একতরফাভাবে সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ প্রায় ১০০টি দেশ কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া, চীন, ভারত, সার্বিয়ার মতো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। রাশিয়া ও চীনের আপত্তির কারণে কসোভো জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি।
প্রেসিডেন্ট ভিয়োসা ওসমানি দেশে নারীর অধিকার, দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার ও ইউরোপ-আটলান্টিক সম্পর্ক সংহত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
৮. আসিমি গোইতা
২০২০ সালের আগস্টে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইব্রাহিম বুবাকার কেইতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে মালির ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল আসিমি গোইতা। তিনি বর্তমানে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। সেবার অভ্যুত্থানের পর তিনি সরাসরি দেশটির শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেননি। ৯ মাস পর ২০২১ সালের মে মাসে গোইতা দ্বিতীয় আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটনা এবং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হন।
গোইতার নেতৃত্বে মালি ফ্রান্স ও অন্যান্য পশ্চিমা অংশীদারদের থেকে দূরত্ব তৈরি করেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। আসিমি গোইতার বয়স এখন ৪২ বছর।
৯. নায়েব বুকেলে
এল সালভাদরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলের বয়স ৪৩ বছর। তিনি ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নিজেকে ‘বিশ্বের প্রথম মিলেনিয়াল প্রেসিডেন্ট’ বলেন তিনি। যদিও সমালোচকেরা তাঁকে ‘মিলেনিয়াল ডিক্টেটর’ বা মিলেনিয়াল স্বৈরাশাসক বলে বর্ণনা করেন।
তবে সমালোচকেরা নায়েব বুকেলেকে স্বৈরাশাসক বললেও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি আবার এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট হন, তিনি প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
ফিলিস্তিনি বাবার ছেলে বুকেলের পূর্বপুরুষ পশ্চিম তীরের বেথলেহেম থেকে এল সালভাদরে এসেছে। ভাইরাল টুইট আর বিটকয়েনের স্বপ্ন দেখিয়ে নায়েব বুকেলে নিজের রাজনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বুকেলে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বুকেলে ট্রাম্প প্রশাসনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া বিশ্বের যেকোনো জায়গার ‘বিপজ্জনক অপরাধীদের’ নিজেদের কারাগারে ঠাঁই দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন। বুকেলে নিজেও গ্যাং ও বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য পরিচিত।
১০. জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক
জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভুটানের পঞ্চম রাজা। তাঁকে দ্রুক গ্যালপো (ড্রাগন কিং) নামে অভিহিত করা হয়। ২০০৬ সালে তাঁর বাবা রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করার পর তিনি রাজা হন। তাঁর বয়স এখন ৪৪ বছর।
জিগমে খেসার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া করেছেন। তিনি ভুটানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ২০০৮ সালে দেশটিতে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজা জিগমে খেসার ভুটানের ডিজিটাল রূপান্তর, স্মার্ট সিটি অবকাঠামো ও নতুন অর্থনৈতিক করিডোর তৈরির প্রকল্প চালু করেছেন; যা দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের রূপরেখা নির্ধারণ করছে।
তথ্য সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আল–জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান ও সিএনএন
