‘কে জানে, পঞ্চম ডাকটা কার আসে…’ — রাসেদুলের স্ট্যাটাসই হয়ে গেল জীবনের শেষ সত্য!
কখনও কখনও একটি বাক্যই জীবনের আগাম সংবাদ হয়ে আসে। তিন বছর আগে নিজের ফেসবুকে এমনই এক বাক্য লিখেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেদুল ইসলাম—
“কে জানে, পঞ্চম ডাকটা কার আসে…”
তখন সেটি ছিল এক তরুণের বিষণ্ণ ভাবনা, বন্ধুহারা এক মনের নিঃশব্দ উচ্চারণ। কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাসে, সেই বাক্যই হয়ে উঠল তার জীবনের শেষ সত্য।
গতকাল রবিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল পৌনে ৩টার দিকে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ভবানীপুর ঘাটে বজ্রপাতে মারা যান রাসেদ। নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। হঠাৎ ঝলসে ওঠে আকাশ, গর্জে ওঠে বজ্র— মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। কয়েক সেকেন্ডেই নিভে যায় এক তরুণ জীবনের দীপ্ত আলো।
রাসেদ ছিলেন ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স কম, কিন্তু চিন্তায় গভীর। সিনেমা ছিল তার ভাষা— লেন্সের ওপারে তাকিয়ে পৃথিবীকে বুঝতে চাইতেন। বন্ধুদের চোখে রাসেদ ছিলেন “চুপচাপ কিন্তু উজ্জ্বল”— যার উপস্থিতি আশেপাশে আনত উষ্ণতা ও প্রাণ।
কিন্তু সেই হাসির আড়ালে ছিল এক গোপন শোক। কয়েক বছরের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন তার চার ঘনিষ্ঠ বন্ধু— জিসান, মহিন, রাজু ও কাকন। তাদের চলে যাওয়া নীরবে ভেঙে দিয়েছিল রাসেদকে। সেই সময়েই তিনি লিখেছিলেন সেই দীর্ঘ স্ট্যাটাস, যা আজ পড়লে মনে হয় যেন নিজের ভাগ্যই লিখে গিয়েছিলেন— “মৃত্যু তো একটা অনিবার্য সত্য। কিন্তু ইদানিং কেন জানি নিজের মৃত্যুর কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। হয়তো কারণ, আমার বন্ধুদের মধ্যে এক অদ্ভুত ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। একে একে চারজন চলে গেল। কে জানে, পঞ্চম ডাকটা কার জন্য আসবে?”
স্ট্যাটাসের শেষে আরও লিখেছিলেন— “জিসানের মৃত্যুর দিনটায় আমি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। তখনই বুঝলাম— মৃত্যু শুধু বয়সের বিষয় নয়, সে আসতে পারে যে কোনো সময়।”
তিন বছর পর, সেই আশঙ্কাই যেন সত্যি হলো। এখন সেই তালিকার পঞ্চম নাম— রাসেদুল ইসলাম।
তার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সহপাঠীরা কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না, এত হঠাৎ করে রাসেদ চলে যেতে পারে! ক্লাসরুম, করিডোর, ক্যাফেটেরিয়া— সবখানেই তার স্মৃতি ভাসছে।
সহপাঠী নাফিজ বলেন, “রাসেদ শুধু বন্ধু না, একটা চিন্তা ছিল। ওর চোখে পৃথিবীটা অন্যরকম দেখা যেত— খুব শান্ত, কিন্তু খুব গভীর।”
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষকরা জানান, রাসেদ ছিলেন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী। সিনেমা নিয়ে তার ভাবনা ছিল পরিণত ও মানবিক। কিছুদিন আগে জীবন ও সময় নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাও করছিলেন তিনি।
রাসেদের পুরোনো পোস্টগুলো এখন পড়লে এক ধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে যায়— যেন প্রতিটি বাক্যের ভেতর লুকিয়ে ছিল মৃত্যুচেতনা, অথচ সেই চেতনা জন্মেছিল জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন— “যে গোপনে আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই সে জানতে পারিল না।”
"আজ তার এই লাইনগুলো বন্ধুদের মনে বাজছে বারবার।
চার বন্ধুর পর এবার সত্যিই এল ‘পঞ্চম ডাক’।
এবার সেই সারিতে যুক্ত হলো নতুন এক নাম"— রাসেদুল ইসলাম।
"চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক অসমাপ্ত গল্প—
এক তরুণ, যে জীবনের অর্থ খুঁজতে চেয়েছিল সিনেমার আলো-অন্ধকারে,
এবার নিজেই হয়ে গেল সেই গল্পের সবচেয়ে নিঃশব্দ দৃশ্য।"


