বিশ্বে কোনো শিল্পেই মানবকর্মী থাকবে না, এআই গবেষকের স্টার্টআপ

মানুষের কাজের জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত নিয়ে বিশ্বের প্রযুক্তিকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালিতে আত্মপ্রকাশ করল বিতর্কিত স্টার্টআপ ‘মেকানাইজ’। বিখ্যাত এআই গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা তামায় বেসিরোগ্লু ঘোষণা দিয়েছেন, এই স্টার্টআপের লক্ষ্য হলো—‘সব ধরনের কাজের পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়করণ’ এবং ‘সম্পূর্ণ অর্থনীতির স্বয়ংক্রিয়তা নিশ্চিত করা’। অর্থাৎ, এমন এক সমাজ তৈরি পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যেখানে কোনো শিল্পেই মানবকর্মী থাকবে না।
গত বৃহস্পতিবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে এই নতুন স্টার্টআপ সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তামায় বেসিরোগ্লু। অনেকেই বলছেন, এত দিন গবেষণাধর্মী কাজের জন্য পরিচিত বেসিরোগ্লু তার প্রতিষ্ঠিত সম্মানজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইপক’-এর ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। ইপক-এর এক পরিচালক এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, ‘আমার জন্মদিনে এই খবর শুনতে চাইনি।’
স্টার্টআপটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে, যেখানে যেকোনো ধরনের পেশাজীবীর কাজ সম্পূর্ণরূপে এআই এজেন্ট দিয়ে করানো যাবে। এ জন্য তারা প্রয়োজনীয় ডেটা, মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করবে।
বেসিরোগ্লু বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর মানব শ্রমিকদের প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার মজুরি দেওয়া হয়, আর বিশ্বব্যাপী এই অর্থ ৬০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। সুতরাং আমাদের বাজার সম্ভাবনা বিশাল।
তবে তিনি এটিও স্পষ্ট করেছেন যে, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য মূলত হোয়াইট-কলার (প্রশাসনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক) কাজের স্বয়ংক্রিয়করণ, কায়িক শ্রম নয়।
তবে এই ঘোষণা ইতিমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। ইপক-এর গবেষণা যেহেতু মূলত এআই-এর অর্থনৈতিক প্রভাব এবং দক্ষতা যাচাই নিয়ে, অনেকেই মনে করছেন এই নতুন স্টার্টআপ আসলে সেই গবেষণাকে কৌশলে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে।
এক্সের ব্যবহারকারী অ্যান্থনি অ্যাগুইরে বলেন, ‘ইপকে প্রতিষ্ঠাতাদের কাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আছে, তবে এই নতুন উদ্যোগ দেখে খারাপ লাগছে। মানুষের বেশির ভাগ কাজ স্বয়ংক্রিয় করা অবশ্যই বড় কোম্পানিগুলোর জন্য এক বিশাল পুরস্কার, আর এ কারণেই বড় বড় কোম্পানিগুলো বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে এটা সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হবে বলে আমি মনে করি।’
এদিকের আরেক ব্যবহারকারী অলিভার হাব্রিকা বলেন, ‘আহা, এটা দেখে তো মনে হচ্ছে ইপকের গবেষণা সরাসরি ফ্রন্টিয়ার এআই সক্ষমতা উন্নয়নে ব্যবহার হচ্ছিল—যদিও আমি আশা করেছিলাম, এটা অন্তত আপনার (তামায় বেসিরোগ্লুর) হাত ধরে ঘটবে না।’
সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা মনে করেন, ইপক-এর উচিত ছিল ওপেনএআই-এর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে আরও স্বচ্ছ থাকা।
এটি প্রথম নয়, যখন ইপক বিতর্কের মধ্যে পড়েছে। গত ডিসেম্বরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে। সে সময় ইপক জানায় যে, ওপেনএআই তাদের একটি এআই বেঞ্চমার্ক (মানদণ্ড) তৈরিতে সহায়তা করেছিল। আর সেই বেঞ্চমার্ক ব্যবহার করেই চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি তাদের নতুন ও৩ মডেল উন্মোচন
তবে সমালোচকেরা বলেন, ইপক তাদের এবং ওপেনএআই-এর সম্পর্কটি প্রকাশ্যে এবং স্পষ্টভাবে জানায়নি। অনেকেই মনে করেন, ইপক যদি তাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে আগে থেকেই পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, তবে জনসাধারণের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হতো না।
এদিকে, বেসিরোগ্লু জানিয়েছেন, মেকানাইজ-এর পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী বিনিয়োগকারীরা—নাট ফ্রিডম্যান, ড্যানিয়েল গ্রস, প্যাট্রিক কলিসন, দ্বারকেশ প্যাটেল, জেফ ডিন, শল্টো ডগলাস এবং মার্কাস আব্রামোভিচ।
প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট টেকক্রাঞ্চকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আব্রামোভিচ জানান, ‘এই দলটি অনেক ক্ষেত্রেই অসাধারণ এবং এআই নিয়ে তারা সবচেয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছে।’
তীব্র সমালোচনার মাঝেও বেসিরোগ্লু দাবি করেন, কর্মক্ষেত্রে এআই এজেন্টদের সম্পূর্ণ নিয়োগ মানব জাতিকে দরিদ্র না করে বরং আরও সমৃদ্ধ করবে। তিনি বলেন, ‘পুরো শ্রম ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়তা বিশাল সমৃদ্ধি, উচ্চমানের জীবনযাপন, এবং এমন নতুন পণ্য ও পরিষেবা সৃষ্টি করতে পারে যা এখনো কল্পনার বাইরে।’
তবে সমালোচকেরা বলছেন, কাজ না থাকলে মানুষের আয়ের উৎস কোথা থেকে আসবে! এর জবাবে বেসিরোগ্লু বলেন, ‘মানুষ শুধু মজুরি থেকেই আয় করে না, বরং ভাড়া, লভ্যাংশ ও সরকারি ভাতার মাধ্যমেও আয় করে। এমনকি যদি মজুরি কমেও যায়, তবু সামগ্রিক অর্থনীতি বাড়বে।’
বেসিরোগ্লু স্বীকার করেছেন, এখনো এআই এজেন্টগুলো তেমন কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে না। তার মতে, এজেন্টরা বর্তমানে ভুল করে, তথ্য ধরে রাখতে পারে না, স্বাধীনভাবে কাজ শেষ করতে পারে না, এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুসরণে ব্যর্থ হয়।
তবে বেসিরোগ্লু একা নন—মাইক্রোসফট, সেলসফোর্সের মতো বড় বড় কোম্পানিও এখন এজেন্ট প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি নতুন অনেক স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে, যারা এআই এজেন্ট দিয়ে বিক্রয়, আর্থিক বিশ্লেষণ, প্রশিক্ষণ ডেটা তৈরি এবং দামের হিসাব-নিকাশের মতো কাজ সহজ করার চেষ্টা করছে।
সব মিলিয়ে, মেকানাইজের লক্ষ্য যতই বিতর্কিত হোক, প্রযুক্তিগত দিক থেকে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয় ‘মানুষ ছাড়া সব কাজ’ করানো, তবুও কাজের মাঝে মানুষের কাজের গতি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে এআই এজেন্টরা। যার ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি আরও এগিয়ে যেতে পারে।
আর যারা ভবিষ্যতের এআই শ্রমবাজারে জায়গা করে নিতে চান তাদের জন্য বেসিরোগ্লু জানিয়েছেন, ‘মেকানাইজ স্টার্টআপ এখন নিয়োগ দিচ্ছে।
তথ্যসূত্র: টেকক্রাঞ্চ
