অন্তর্মুখীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আরও ভালোভাবে মেশার তিনটি পরামর্শ

মার্কিন লেখক, বক্তা ও প্রশিক্ষক কেলি থম্পসন এক লেখায় নিজের অন্তর্মুখী স্বভাব এবং এ কারণে কর্মক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যাগুলো অতিক্রম করার উপায় তুলে ধরেছেন। তাঁর বয়ানেই জেনে নেওয়া যাক কীভাবে তিনি অন্তর্মুখী হয়েও কর্মক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন।
আমি অন্তর্মুখী। তাই সব সময় মনে হতো, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলাকালে আমি কথা বলি না। কিন্তু তারপর উপলব্ধি করলাম, আমার নিজের ভালো গুণগুলোর প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া এবং যোগাযোগে ভালো করার দিকে নজর দেওয়া উচিত। আরও বুঝতে পারলাম, সব সময় আমার কথা বলার আদতে প্রয়োজনও নেই।
আমি কাজ করতাম এক স্বাস্থ্যসেবাদাতা কোম্পানিতে। একদিন অন্য এক কোম্পানি আমাদের কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করল। আমাদের নতুন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল সান দিয়াগোতে। আমাকে ঘিরে একটা টেবিলের চারপাশে কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে বসে ছিলেন। এদিকে আমি ভাবছিলাম, তাঁরা কি কোম্পানি একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? আমার খুবই অবাক লাগছিল, তাই চুপ করে রইলাম। সেদিনের মিটিংয়ে বলতে গেলে অংশই নিইনি। শুধু মনে হচ্ছিল, তাঁরা ভাবছেন, আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? কেন আমি খামাখা একটা চেয়ার দখল করে রেখেছি?
মিটিংয়ের পর হোটেলে নিজের রুমে গিয়ে ভাবতে থাকলাম, আমার কী কী বলা উচিত ছিল, কী কী প্রশ্ন করতে পারতাম, এ রকম আরও অনেক কিছু। আর অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য নিজেকে দোষ দিতে থাকলাম। মনে হলো, ইশ্, যদি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম! নিজের চিন্তাভাবনা আর আইডিয়াগুলো দ্রুত গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারতাম!
আমি অন্তর্মুখী—কথাটি যখন বলি, তখন মানুষ প্রায়ই অবাক হয়। কারণ, আমি আমার ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কাজ করেছি প্রশিক্ষক ও বক্তা হিসেবে।
নিজেকে চেনার জন্য কিছু পরীক্ষা করার এবং মার্কিন লেখক সুজান কেইনের ‘কোয়ায়েট: দ্য পাওয়ার অব ইন্ট্রোভার্টস ইন আ ওয়ার্ল্ড দ্যাট ক্যান নট স্টপ টকিং’ বইটি পড়ার পর আবিষ্কার করলাম, আমি আদতেই অন্তর্মুখী। বইটি আমাকে নিজের কিছু ইতিবাচক দিক আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে, যেসব অন্তর্মুখিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন মনোযোগ দিয়ে শোনা; যা কিছু শুনি, তা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করা এবং ভালো প্রশ্ন করতে পারা।
এর অর্থ হলো আমি অনেক বহির্মুখীর মতো মুখে কোনো কথা বলি না। আমার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অফিসের পরিবেশে খাপ খাওয়ানো আমার জন্য কঠিন হতে পারে। অনেক অফিস চলেই শুধু মিটিং আর মুক্ত আলোচনার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক অন্যভাবে কাজ করে। তাই আমাকে আমার পথ খুঁজে নিতে হয়েছে। নিচের ৩টি পরামর্শ অন্তর্মুখী হয়েও কর্মক্ষেত্রে আমাকে উন্নতি করতে সহায়তা করেছে।
১. নিজের ইতিবাচক দিকগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে শিখেছি
সেদিন মিটিং শেষে হোটেল রুমে ফিরে আসার পর লিখতে বসলাম, কী কারণে কোম্পানির সিইও আমাকে মিটিংয়ে রেখেছেন এবং কোম্পানি একীভূতকরণের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে নির্বাচিত করেছেন। কয়েকটি কারণ ভেবে বের করতে পারলাম। যেমন আমি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম; প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমার দক্ষতা আছে।
বুঝতে পারলাম, অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে আমার যেসব গুণ আছে, যেমন মনোযোগ দিয়ে শোনা, ভালো ভালো প্রশ্ন করা, এসব গুণ আমার ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আমি একজন দলনেতা হিসেবে ভালো করতে পারব।
আরও বুঝতে পারলাম, আমার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর না–ও থাকতে পারে। তবু নিজের শিখতে ও প্রশ্ন করতে পারার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মিটিংয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি কিংবা গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যা কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন, সেসব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারি।
২. শব্দ বাছাইয়ের পরিবর্তে সংযোগ তৈরির ওপর মনোযোগ দিয়েছিলাম
প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। আমার কী বলা উচিত, সঠিক পদ্ধতি কী, যদি দর্শক-শ্রোতা আমাকে বোকা ভাবে? এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম।
এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখেছি, কোন পদ্ধতিতে প্রেজেন্টেশন দেওয়া আমার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? প্রেজেন্টেশনটির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করতে চাই?
যখন এভাবে চিন্তা করতে শুরু করলাম, তখন আমার ভয়গুলো নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। বরং দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে আমার সংযোগ গড়ে তোলার প্রতি বেশি করে নজর দিলাম।
৩. আমার শুধু তখনই কথা বলা উচিত, যখন আমাকে বলতেই হবে
বেশ কয়েক বছর আগে আমার ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলাম। আর্টিকেলটি যখন ছাপা হলো, তখন অনেকেই না জেনে–বুঝে অনেক মন্তব্য করতে শুরু করলেন, যা ছিল ভীষণ কষ্টদায়ক।
কমেন্টগুলো পড়ে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু আর্টিকেলটি লেখার জন্য আমার কোনো অনুশোচনা হয়নি। কারণ, বন্ধ্যাত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং কর্মস্থল–সংক্রান্ত নীতিমালার উন্নয়নের পক্ষে কথা বলা আমার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখলাম, আমার কথাগুলো তখনই সবচেয়ে শক্তিশালী হবে, যখন কথাগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। আগে মনে করতাম, বহির্মুখী এবং সফল হতে হলে আমাকে সবকিছু নিয়েই কথা বলতে হবে। বিষয়টি আদতে এমন নয়। আমাকে খুঁজে নিতে হবে আমার কাছে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো সেই বিষয়েই আমাকে কথা বলতে হবে। বুঝতে পেরেছি, জীবনে সফল হতে হলে আমি যেমন, সেভাবেই নিজেকে গ্রহণ করতে হবে। আমি কী বলব এবং কখন বলব, সে ব্যাপারে নিজেকেই নির্দেশনা দিতে হবে।
