রাবিতে গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর শীর্ষক নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) "গণঅভ্যুত্থান: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর" শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।সোমবার (২৮ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টায় সৈয়দ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজের আয়োজনে এ সভা হয়।
সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, ভাবুক ও কবি ফরহাদ মজহার।প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ।
প্রধান আলোচক ফরহাদ মজহার বলেন, গণঅভ্যুত্থান বলতে আমরা কী বুঝি, সেই বিষয়ে আমাদের সমাজে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য বোঝানোর জন্যও প্রয়োজন। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি, নারীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু এখন তারা রাজপথ থেকে হারিয়ে গেছে, কারণ তারা আর নিরাপদ বোধ করে না। এ পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটিকে প্রকাশ করে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে রচিত হয়নি, তাই আমরা সেটি বাতিল করতে চেয়েছিলাম। বর্তমানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি নতুন গঠনতন্ত্র প্রয়োজন, যা হবে জনগণের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। এই গঠনতন্ত্র তিনটি মূলনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠতে হবে— রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না যাতে ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি হয় কিংবা জীবন ও জীবিকার মান নষ্ট হয়। জনগণের দাবি ও স্বপ্নকে মর্যাদা দিতে হলে একটি ন্যায্য ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, গণতন্ত্র মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চিমে গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। আমাদের সমাজে যখন ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলা হয়, তখন সেটি ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যক্তির স্বাধীনতা বজায় রেখেই কীভাবে আমরা সমষ্টির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করবো?
তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দেখিয়েছে, ব্যক্তি নয়, একটি সমষ্টির আকাঙ্ক্ষা কিভাবে মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যারা জীবন দিয়েছে, তারা কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং সমষ্টির একটি উচ্চতর স্বপ্নের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এ আত্মত্যাগের রাজনৈতিক, দার্শনিক কিংবা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার যথেষ্ট প্রয়াস নেই। গণতন্ত্রের এ দিকটি নতুন করে ভাবতে হবে।
রাবি উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, আমাদের বড় সমস্যা হলো— কৃতিত্ব নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আমরা কে কত বড় ভূমিকা রেখেছি তা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকি যে, প্রকৃত বয়ান তৈরি হয় না। রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের বড়াইয়ের কোনো মূল্য নেই। আজকের বাংলাদেশে বামপন্থী বা ডানপন্থী দলগুলো নিজেদের কৃতিত্ব বড় করে দেখানোর জন্য বয়ান তৈরি করে, অথচ বাস্তবতা হলো— এতে সমাজের কিছুই বদলায় না। নিজেদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেদের বোকা বানানোর এ খেলা বন্ধ করতে হবে। কৃতিত্ব নিয়ে নয়, বরং টেকসই, ন্যায়ভিত্তিক ও যৌক্তিক বয়ান তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ।