রংপুর বিভাগের ৮ জেলার অর্ধশতাধিক বেসরকারি পাঠাগার নিয়ে ‘বিভাগীয় পাঠাগার সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৩ নভেম্বর রংপুরের পাবলিক লাইব্রেরি হলরুমে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের আয়োজনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের প্রথম পর্বে বিভিন্ন পাঠাগারের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে সাংগঠনিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি রফিকুল ইসলাম। প্রধান আলোচক ছিলেন কেন্দ্রীয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রহমান রায়হান।
আলোচনা করেন কুড়িগ্রামের সাতভিটা গ্রন্থনীড়ের প্রতিষ্ঠাতা জয়নাল আবেদীন, পঞ্চগড়ের একুশে স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি শেখ আবুল হোসেন সিলন, রংপুরের প্রজন্ম সমাজ-সংস্কৃতি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মীর রবি, নীলফামারীর শ্রমকল্যাণ পাবলিক পাঠাগারের সভাপতি জামিয়ার হোসেন, দিনাজপুরের রোকেয়া-তাজিমউদ্দিন খান গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ মোনায়েম খান, গাইবান্ধার বিমল সরকার সাহিত্য সম্ভার ও পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক শামীম সরকার।
সম্মেলনে বিভিন্ন আলোচনায় পাঠাগারের বইপাঠ কর্মসূচি বেগবান করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটানোর বিষয় উঠে আসে। স্থানীয় পর্যায়ে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের তাগিদ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পাঠাগারের নানামুখী সংকট নিরসনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার কথাও উঠে আসে।
দ্বিতীয় পর্বে ‘নদী ও প্রাণ প্রকৃতি রক্ষায় পাঠাগারের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ। আলোচনায় অংশ নেন চলচ্চিত্রকার ও স্থপতি মসিহউদ্দিন শাকের, তিস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য, বইবন্ধু কাজী এমদাদুল হক খোকন, গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব সফি খান এবং নাট্যকার ও নির্দেশক সরকার হায়দার। সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি আবদুস ছাত্তার খান।
মূল প্রাবন্ধিক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘অতীতের নদী ও প্রাণ-প্রকৃতির সন্ধান পেতে যেমন বই তথা পাঠাগারমুখী হওয়া জরুরি; তেমনই বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্যও পাঠাগার জনগুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাস অনুকূল পৃথিবী দিতে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতির পাঠ গ্রহণের জন্য পাঠাগারের অনন্য ভূমিকা আছে।’
প্রধান অতিথি প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘পাঠাগারের সংকট উত্তরণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। পাঠাগরকে রক্ষা করে গেলে পরিবেশ সুরক্ষার কাজও এগিয়ে যাবে। আমরা যদি সমাজের সচেতন চোখ বৃদ্ধি করতে চাই, তাহলে অবশ্যই বই পড়তে হবে। পাঠাগারে যেতে হবে। আশার বাতি জ্বালাতে আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। গতিশীলতা আনতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। পাঠাগার কোনো খণ্ডিত বিষয় নয়, আমাদের জীবনের পূর্ণাঙ্গ জায়গা। প্রকৃতিকে স্বমহিমায় সবুজাভ করতে পাঠাগারের কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন।’
চলচ্চিত্র পরিচালক ও স্থপতি মসিহউদ্দিন শাকের বলেন, ‘ছেলেবেলায় আমি বই পড়তাম আর বইয়ের পাতায় সিনেমা দেখতাম। আমার সিনেমা নির্মাণের অনুপ্রেরণা ছিল বইপাঠ। আমি মনে করি, জ্ঞানার্জনের একমাত্র পথ বই। বই পড়তে পাঠাগার জরুরি। নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায়ও পাঠাগার ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের অজ্ঞতা দূর করতেও পাঠাগারের শরণাপন্ন হতে হবে।’
অধ্যাপক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য বলেন, ‘মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। তৈরি হয় বই লেখা ও পড়ার প্রয়োজনীয়তা। আমাদের মেধা ও মননের জায়গায় উৎকৃষ্টতা অর্জনে প্রাণ-প্রকৃতি ও পাঠাগারের সম্পর্ক নিবিড়। প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে মানবসমাজও ধ্বংস হয়ে যায়। এমন অবস্থায় পাঠের মধ্য দিয়ে নদী প্রাণ-প্রকৃতির বোধ তৈরি করে দিতে পারে পাঠাগার। পাঠাগার হবে মুক্তচিন্তার বিশ্ববিদ্যালয়, গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়। পাঠাগারই মানুষকে একত্রিত করে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় চিন্তার ঐক্যে পৌঁছে দিতে পারে।’
গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব সফি খান বলেন, ‘নদীর ইতিহাস জানতে হলে নদীর কাছে যেতে হবে, নদীর ইতিহাস পড়তে হবে। এজন্য যেতে হবে পাঠাগারে। নদীর ইতিহাস ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ইতিহাস লেখা আবশ্যক। পাঠাগার কাজটি করতে পারে।’
সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের সভাপতি আবদুস সাত্তার খান স্থানীয় বিভিন্ন নদ-নদী ও জলাশয় রক্ষায় পাঠাগারকর্মীদের সচেতনতা তৈরির আহ্বান জানান। স্থানীয় নদী ও প্রাণ-প্রকৃতির ইতিহাস সংরক্ষণে পাঠাগার গুরুত্বপূর্ণ উপায় হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে পাঠাগারগুলোকে উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ জানানো হয়।
একই সঙ্গে পাঠাগার কার্যক্রমকে প্রসারিত করতে সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন আলোচকরা। সম্মেলনে পাঠাগার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে রফিকুল ইসলামকে সভাপতি ও জয়নাল আবেদিনকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট রংপুর বিভাগীয় সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।