১৯৬৯। ২৯ অক্টোবর। সাড়ে তিন শ মাইল দূরে অবস্থিত দুই বিজ্ঞানী তাদের কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হলেন। একটা বার্তা টাইপ করছিলেন। টাইপের কাজ যখন মাঝ পর্যায়ে, তখনই ঘটল বিপর্যয়। কম্পিউটার অচল হয়ে গেল। ক্রাশ করল। এ ঘটনার ৫৫ বছর পরে, চলতি বছরে, সেই আলাপ বিবিসির স্কট নোভেরের সাথে।
শীতল যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। চার্লি ক্লিন এবং বিল ডুভাল প্রতিভার উজ্জ্বল প্রভায় দীপ্যমান দুই তরুণ বিজ্ঞানী তৎকালীন উচ্চাভিলাষী অন্যতম এক গবেষণায় নিমগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। ২১ বছর বয়সী ক্লিন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) গ্র্যাজুয়েট। ২৯ বছর বয়সী ডুভাল, স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআরআই) গবেষক। আরপানেট, পুরো নাম অ্যাডভানসড রিসার্চ প্রজেক্টস নেটওয়ার্কে কাজ করছেন দুজনেই। তহবিলের জোগানদার ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য, টেলিফোন লাইন ছাড়াই যেন ডেটা আদান-প্রদান করা যায়। এ জন্য ডেটা আদান-প্রদানের কাজে ‘প্যাকেট সুইচিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন তারা। এই ব্যবস্থাই পরবর্তী সময়ে আধুনিক ইন্টারনেটের ভিত্তি তৈরি করে।
এ প্রযুক্তি কাজ লাগে কি না, তাই সেদিন প্রথম পরীক্ষা করছিলেন তারা। ভবিষ্যতে তাদের এ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই গোটা মানুষ জাতির প্রায় সবকিছুকেই পরিবর্তন করে দেয়।
ক্লিন ইউসিএলএর বোয়েলটার হলরুম ৩৪২০ থেকে সাড়ে তিন শ মাইল দূরের ডুভালের সাথে সংযোগের চেষ্টা করছিলেন। লগইন শব্দটি পুরোপুরি টাইপ করার আগেই ডুভালের ফোন এল। জানালেন, কম্পিউটার ব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। ১৯৬৯-এ সেদিন ক্লিন কেবল ‘এল’ এবং ‘ও’ এই দুই ইংরেজি হরফ পাঠাতে পেরেছিলেন।
টুকটাক কিছু মেরামত সেরে ঘণ্টাখানেক পর আবার সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন তারা। সেদিন তাদের বিশাল অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে কম্পিউটার অচল হয়ে পড়াকে সামান্য ঘটনার পর্যায়ে ফেলা যায়। দুই বিজ্ঞানীর কেউই সেদিন আন্দাজ করতে পারেননি, ওই সময়টা কী বিশাল গুরুত্বের ছিল। ক্লিন খোলাখুলি স্বীকার করেন, গুরুত্বের বিষয়টি আমি মোটেও অনুমান করতে পারিনি। পদ্ধতিটি যেন কাজ করতে পারে, সেদিকেই ছিল পুরো মনোযোগ।
এ ঘটনার ৫৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই দুই বিজ্ঞানীর সাথে আলাপচারিতার শুরু।
আলাপের প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছিল, আরপানেটের জন্য তারা যে কম্পিউটার ব্যবহার করেছিলেন, তা কি আকারে বড় এবং শব্দবহুল যন্ত্র ছিল? জবাবে ক্লিন বলেন, সেকালের মাপকাঠিতে কম্পিউটারগুলোকে ছোটখাটোই বলা যায়। এগুলো আকারে একটা ফ্রিজের সমান ছিল। ওই কম্পিউটার শীতল রাখার জন্য কয়েকটা ফ্যান ব্যবহার করা হতো। তাতেই বেশ শব্দ হতো। তবে অন্য কম্পিউটারগুলোর তুলনায় আমাদের সিগমা ৭ কম্পিউটারের ফ্যানগুলোর শব্দ বরং কমই হতো। কম্পিউটারগুলোর সামনে কয়েকটা লাইট ছিল। সেগুলো পিটপিট করত। ইন্টারফেস মেসেজ প্রসেসর বা আইএমপির কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুটিকয়েক সুইচও ছিল। পাশাপাশি কাগজের টেপ রিডার ছিল। কম্পিউটারে সফটওয়্যার ঢোকানোর কাজে ব্যবহার হতো ওটি।
ডুভাল বলেন, আজকের যুগে বিশাল অনুষ্ঠানের গোটা শব্দব্যবস্থার যন্ত্রপাতি রাখার মতো বড়সড় তাকজুড়ে রাখা হতো ওগুলো। এ ছাড়া এখনকার অ্যাপেল ঘড়িতে যে প্রসেসর বসানো আছে, তার সক্ষমতার থেকেও মিলিয়ন মিলিয়ন বা বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ কম ছিল ওসব কম্পিউটারের সক্ষমতা।
এল এবং ও টাইপ করার বিষয় কথা বলতে গিয়ে ক্লিন বলেন যে আজকের যুগের ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে এসআরআই ব্যবস্থার পার্থক্য ছিল। এসআরআই টার্মিনালের সাথে সংযোগ স্থাপন করলেই হবে না। কিছু টাইপ করতে হবে। তাহলেই সংযোগটা কাজ করবে। যদি কোনো প্রোগ্রাম চালানোর ইচ্ছা থাকে, তবে প্রথম লগইন করতে হবে। এ জন্য টাইপ করতে হবে লগইন শব্দটি। সাথে সাথেই কম্পিউটার নাম এবং পাসওয়ার্ড জানতে চাইবে।
তিনি আরও জানান, টাইপ করার জন্য টেলিটাইপ মডেল ৩৩ ব্যবহার করা হয়েছিল। এসআরআই ব্যবস্থার কাছে তার টাইপ করা অক্ষর বার্তা হিসেবে যাওয়ার জন্য কয়েকটা ধাপ পেরোতে হতো। কিন্তু ওই সব ধাপ পেরিয়ে গেলে আর বোঝা যাবে না বার্তাটি দূর থেকে এসেছে। বরং স্থানীয় টার্মিনাল থেকে এসেছে বলে ধরে নেবে বিলের কম্পিউটার। একে প্রসেস করবে। তারপর আবার ইসিএলএতে ফেরত পাঠাবে। সেখান থেকে প্রিন্ট করে নেবেন ক্লিন। ক্লিন জানান যে ফোনে তিনি বিলের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন। এল টাইপ করার পর বিলকে জানালেন, এল হরফ তিনি পেয়েছেন। এটা প্রিন্ট করা হয়েছে, সে কথাও জানালেন। তারপর টাইপ করলেন ও অক্ষর। এ পর্যন্ত ভালোভাবেই কাজ এগোচ্ছিল। জি টাইপ করার পরই ঝামেলা দেখা দিল। বিল জানান, তার কম্পিউটার অচল হয়ে গেছে। খানিক পরে আমার ফোন করবে বলেও জানান বিল।
এ বিপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডুভাল জানান, আসলে নেটওয়ার্ক সংযোগ অন্য কিছুর থেকে অনেক বেশি গতিশীল ছিল।
তখনকার দিনে স্বাভাবিক সংযোগের গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১০ হরফ। অন্যদিকে আরপানেটের সেকেন্ডে ৫০০০ হরফ পর্যন্ত পাঠানোর তাগদ ছিল। ইউসিএলএ থেকে এসআরআই কম্পিউটার বার্তা পাঠানোর ফল হলো যে বার্তার বন্যায় ভেসে গেল সেখানকার ব্যবস্থা। কারণ, ওখানকার ব্যবস্থা প্রতি সেকেন্ডে ১০টি মাত্র হরফ গ্রহণ করার উপযোগী ছিল। উদাহরণ দিয়ে বলেন, দমকলের আগুন নেভানোর নল দিয়ে তোড়ে আসা পানি দিয়ে গ্লাস ভরতে গেলে যা হবে, এখানেও তা-ই হলো। সমস্যার প্রকৃতি বুঝতে এবং দ্রুত তা সুরাহা করতে বেশি বেগ পেতে হলো না ডুভালের। এক ঘণ্টার মধ্যেই মুশকিল আসান।
এর মধ্য দিয়ে যে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল, সে কথা কী বুঝতে পেরেছিলেন সেদিনের তরুণ দুই বিজ্ঞানী? জানতে চাওয়া হলে ক্লিন জবাব দেন সংক্ষেপে। তিনি বলেন, না। অবশ্যই না। তখন এটা বুঝতেই পারিনি। ডুভাল বলেন, সত্যিই বুঝতে পারিনি। এসআরআইতে যে প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছিলাম, এ সফলতা সেখানে বড়সড় প্রভাব ফেলবে বলেই ভাবনা করেন তিনি।
স্যামুয়েল মোর্স ১৮৪৪ প্রথম টেলিগ্রাম বার্তা পাঠানোর জন্য খানিকটা নাটকীয়তার আশ্রয় নেন। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে পাঠানো তারবার্তায় তিনি লিখেছিলেন, হোয়াট হ্যাথ গড রট (ইশ্বর কি সৃষ্টি করেছেন)। এ ঘটনা উল্লেখ করে দুই বিজ্ঞানীর কাছে জানতে চাওয়া হলো এবারে, যদি পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকত, তবে কী তারা প্রথম পাঠানো বার্তার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু টাইপ করতেন?
ক্লিন বেশ জোর দিয়েই হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। তিনি বলেন, যদি এ বার্তার গুরুত্ব তখন আঁচ করতে পারতাম, তবে অবশ্যই তা বদলে দিতাম। কিন্তু তা হয়নি। আমরা কাজটাকে নিয়ে যেন ভালোভাবে উতরে যেতে পারি, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলাম।
ডুভাল ভিন্নভাবে জবাব দেন। তিনি বলেন, না তা হয়তো করতাম না। পরীক্ষাটাই ছিল বেশ জটিল ব্যবস্থার সাথে জড়িত। এর সাথে চলমান অনেক যন্ত্রাংশ জড়িয়ে ছিল। এ রকম একটা জটিল ব্যবস্থায় প্রথম কাজ করার পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোই চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছিল।
প্রথম বার্তা পাঠানোর পর পরিবেশটা কেমন ছিল, জানতে চাওয়া হলে ডুভাল বলেন, আমরা দুজনেই নিজ নিজ কম্পিউটার ল্যাবে একা একা ছিলাম সে রাতে। অনেক দিনের পরিশ্রম এভাবে সফল হতে দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। স্থানীয় একটি খানাপিনার জায়গায় যাই এবং বার্গার ও বিয়ার নিয়ে বসি। ক্লিন বলেন, কাজটা সফল হওয়ায় খুবই খুশি হয়েছিলাম। বাসায় ফিরে গিয়ে একটা ঘুম দেন বলেও জানান।
আরপানেট কী করতে পারে বলে তারা আশা করেছিলে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডুভাল বলেন, তারা একটি বৃহত্তর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলেন। অনলাইনে মানুষ তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবেন। তবে সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার তাদের কল্পনায় ঠাঁই করে নেয়নি। একইভাবে অতথ্য বা অসত্য তথ্যের প্লাবন ঘটবে, তা-ও ভাবতে পারেননি। ১৯৬২ সালে এসআরআইয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডগলাস এঙ্গেলবার্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে ক্লিন এবং ডুভালের মতো বিজ্ঞানীরা যে বিষয়ে কাজ করছেন, তা মানুষের সামাজিক জগৎকে আমূলে বদলে দেবে। তাদের প্রকল্প ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সমাজে যে সমস্যা দেখা দেবে, পাশাপাশি তা সুরাহা করার ব্যবস্থাও তৈরি করতে হবে বলে হুঁশিয়ারিতে উল্লেখ করেন এঙ্গেলবার্ট।
ইন্টারনেটের কোন কোন দিকগুলো অতীতের আরপানেটের কথা মনে করিয়ে দেয়, এমন প্রশ্ন করা হলে ডুভাল এবং ক্লিন আলাদা আলাদা জবাব দেন।
ডুভাল বলেন, এঙ্গলবার্টের দলটি মাউস, ফুল-স্ত্রিন সম্পাদনা এবং লিংকের মতো বৃহত্তর পরিসরের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেন। এই ধারণাগুলো যৌক্তিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের দিনের ইন্টারনেট রূপান্তরে হয়েছে। এ পথপরিক্রমায় অনেক প্রতিভাদীপ্ত এবং উদ্ভাবনী মানুষ ও সংস্থার অবদান রয়েছে।
আমরা ওয়েবসাইট ব্যবহার করি মানে অন্যের সম্পদকে নিজের কাজে লাগাচ্ছিÑএ কথা বলেন ক্লিন। ওয়েবসাইটের নানা সুবিধা এবং এর প্রোগ্রাম, বৈশিষ্ট্যসহ অনেক কিছুই ব্যবহার করছি। পাশাপাশি ব্যবহার করছি ই-মেইল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বার্তা পাঠালে কেবল একটি পথ দিয়েই যাবে না। ভিন্ন ভিন্ন বা অনেক পথে ধরে যায়। এতে যাত্রাপথের কোথাও কোনো যোগাযোগব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলেও বার্তাটি নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। একই সাথে নানামুখী পথ ব্যবহারের সুফলে বার্তা আদান-প্রদানের গতি বেড়ে যায়। আরপানেটের এই সব ধারণাগুলোকেই ইন্টারনেটে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরপানেটের যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশ ঘটানোর সময় সমস্যা খুঁজে বের করতে হয়েছে, নতুন করে নকশা তৈরি করতে হয়েছে এবং ব্যবস্থাকে উন্নয়ন ঘটাতে হয়েছে। সে সময়ে নতুন নতুন নানান শিক্ষা লাভ করেছেন বিজ্ঞানীরা। পরবর্তী সময়ে এগুলো ইন্টারনেটেও কাজে লেগেছে। টিসিপি/আইপি ইন্টারনেটের যোগাযোগের মৌলিক মানদণ্ড হয়ে ওঠে। সহজ কথায় টিসিপি/আইপি হলো একগুচ্ছ নিয়ম। আমরা যেমন কথা বলার সময় ভাষা ব্যবহার করি এক কম্পিউটারও তেমনি অন্য কম্পিউটারের সাথে কথা বলার সময় টিসিপি/আইপির নিয়মগুলো মেনে চলে।
তাদের গবেষণার ৫৫ বছর পূর্তিতে কেমন লাগছেÑএ কথার জবাব দিতে গিয়ে ক্লিন মিশ্র অনুভূতির কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, আরপানেট এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণার মাধ্যমে যা মিলেছে, সবই গুরুত্বপূর্ণ। বার্ষিকী পালনকে খানিকটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে করেন তিনি। একজন গবেষক হিসেবে তিনি মনে করেন আরপা যখন নেটওয়ার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয় ছিল।
ডুভাল এমন প্রশ্নের জবাবে জানান, ইন্টারনেটের সূচনার কথা মনে রাখা ভালো। তার চেয়েও গুরুত্বের হলো, তখন থেকে বিপুল পরিমাণে কাজ হয়েছে। এসব কাজ ইন্টারনেটকে বিশ্ব সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বানিয়ে দিয়েছে।
আধুনিক ওয়েবে আধিপত্য বিস্তার করেছে কোনো সরকার বা শিক্ষা গবেষণা সংস্থা নয়, বরং বিশ্বের কিছু কিছু বিশাল কোম্পানি। ইন্টারনেটের এই রূপান্তর দুই গবেষকের কাছে কেমন লাগছে? এবং এ ছাড়া ইন্টারনেটের কোন কোন জিনিসকে উদ্বেগজনক মনে হচ্ছেÑজানতে চাওয়া হয়।
ক্লিন বলেন, ইন্টারনেটকে অষ্টপ্রহরের জীবনে ব্যবহার করা হচ্ছে, এটা সত্যিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেটহীন জীবনযাপনের কথা আর ভাবাই যায় না। এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্টারনেটের জগৎ খোলামেলা হওয়ায় এবং সরকার এ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে না থাকার অন্যতম সুফল হলো, নতুন নতুন ভাবধারার বিকাশ ঘটা। এই যেমন অনলাইন কেনাকাটা, ব্যাংকিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, নতুন নতুন সাইট, সামাজিক মাধ্যম এবং আরও অনেক কিছু। অন্যদিকে ইন্টারনেট মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাই দুষ্ট তৎপরতার লক্ষ্যবস্তুও হয়ে উঠছে।
প্রতিনিয়তই শোনা যায়, কীভাবে নিরাপত্তাজনিত নানান সংকট হচ্ছে। ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্লিন মনে করেন, গুগল, মেটা, আমাজন এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারী সংস্থা কমকাস্ট এবং এটিঅ্যান্ড টির মতো বড় বড় কোম্পানির প্রচণ্ড ক্ষমতা রয়েছে। এ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ কী হতে পারে, তার আভাস অবশ্য দিতে পারেননি ক্লিন।
এদিকে বিপদ রয়েছে বলে জানান ডুভাল। তিনি বলেন, এককভাবে কেউ যদি ইন্টারনেটে আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে মহাবিপদ দেখা দেবে। নীতিনির্ধারণ বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতথ্য বা অসত্য তথ্যের দাপট কতটা হতে পারে, তা এরই মধ্যে দেখা হয়ে গেছে। সামাজিক দিক নির্দেশনা এবং বয়সী ও তরুণদের মানস গঠনে কোম্পানিগুলোর প্রভাব খাটানোর বিষয় সবাই চাক্ষুষ করছেন, তা-ও জানান তিনি। সমস্যার এই জটিল রূপটি কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে, তা মোটেও জানা নেই ডুভালের। অবলীলায় স্বীকার করেন।
ক্লিন একই দুর্ভাবনা প্রসঙ্গে বলেন, অতথ্য বা অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ডকারখানা তার কাছে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, এটা আমি ইন্টারনেটে দেখেছি, কাজেই ওটা আপনাআপনি সত্য হয়ে গেছে! অতীতের সাথেও তুলনা করেন তিনি। তিনি বলেন যে অতীতকালে অতথ্য বা ভুল তথ্য প্রচার করা কঠিন ছিল। ছিল ব্যয়বহুল। এ জন্য খবর বিলি করার মানুষ লাগত, বিলবোর্ড বা বিজ্ঞাপন ঝোলানোর ব্যবস্থা করতে হতো কিংবা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হতো। বর্তমান এ কাজ সস্তা হয়ে গেছে। লাখো লাখো মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। ভুয়া খবর বারবার বলা হলে সত্য হয়ে ওঠে।
আরেকটি দুর্ভাবনা হলো, ব্যাংক, দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং পরিবহনের মতো অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো ইন্টারনেট-নির্ভর হয়ে উঠছে। ইন্টারনেটে হামলা করলে বা হ্যাক করার মধ্য দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ সেবাতে বাধা তৈরি করা যায়।
ডুভাল আরও যোগ করেন, ইন্টারনেটের রয়েছে মহাশক্তি; কিন্তু ১৯৬২-তে ইঙ্গেলবার্টের দেওয়া হুঁশিয়ারিকে কেউ গ্রাহ্য করেননি। সামাজিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেটকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেনি মানুষ।
আরপানেট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু কী শিখেছেন, যা ইন্টারনেটকে সবার জন্য ভালো করে তুলতে পারেÑএ প্রশ্ন তোলা হয় দুই বিজ্ঞানীর কাছে।
জবাবে ক্লিন বলেন, ইন্টারনেটটি খোলামেলা থাকায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন নতুন ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরপা কিছুটা হলেও আরপানেটকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। এভাবেই সবকিছু যেন ঠিকঠাক কাজ করে, তা নিশ্চিত করা গেছে। ডেটা আদান-প্রদানবিষয়ক প্রয়োজনীয় মাপকাঠি বা প্রটোকলগুলো কী হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এ ছাড়া সাইটের নামকরণসংক্রান্ত বিষয়সহ অন্যান্য সমস্যার সুরাহা করেছে। ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস বা আইক্যান এখনো এ সমস্যার কিছু কিছু দেখাশোনা করছে। সামনে কীভাবে এগোতে হবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মতানৈক্য রয়েছে, ইন্টারনেটের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে বলা চলে কি না, এমন সব বিষয় রয়েই গেছে। আরপানেট তুলনামূলকভাবে খুবই ছোট ছিল। নকশা, প্রটোকল বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে সে সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সহজ ছিল। কিন্তু আজকের দিনে এমন কাজ যারপরনাই মুশকিলের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডুভাল এবারে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টিও টেনে আনলেন। তিনি বলেন, মানুষ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ইন্টারনেটের প্রাথমিক দিনগুলোর মতোই এআই দ্রুত বেগে বাড়ছে। এআই সমাজের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, এআই এখন ইন্টারনেটের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। মানুষের জীবনযাত্রার জন্য এআই হুমকি হয়ে উঠছেÑএ কথা বলাটা অন্যায় হবে না। এআইয়ের কল্যাণ এবং ঝুঁকি উভয়ই মানুষকে বুঝতে হবে বলেও জানান তিনি।