আজ- বুধবার | ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:২৪
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলার বাঘিনীদের ব্যবহার করতে হচ্ছে একটি বাথরুম

সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ঘরের মাঠে ৪-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশের একঝাঁক কিশোরী,সময়টা ছিলো,২০১৬ সালের ০৫ সেপ্টেম্বর। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ছয় দলের ‘সি’ গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্তপর্বে নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।

অতীতে বিচ্ছিন্ন কিছু সাফল্য এলেও দেশের নারী ফুটবলে সত্যিকারের উত্থানটা ঘটে সেই আসরেই। এমন সাফল্যে খুশি হয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্প করার। বাফুফে ভবনের চতুর্থতলার ডরমেটরিতে তোলা হয় মেয়েদের। এরপর কেটে গেছে আট বছর।

সাবিনা, মারিয়া, সানজিদাদের ঠিকানা এখন সেই বাফুফে ভবন। একটি দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থতলার ১১টি কক্ষ বরাদ্দ ৬০ থেকে ৭০ জন নারী ফুটবলারের জন্য। যে ভবনে নেই কোনো লিফট। দৈনিক একাধিকবার মাঠের ট্রেনিং, জিম সেরে সেই ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত মেয়েদের পৌঁছাতে হয় নিজেদের কক্ষে। ফুটবল ভবনে বারোয়ারি মানুষের নিত্য আশা-যাওয়া। তাই সিঁড়ি বাইতে গিয়ে মেয়েদের পড়তে হয় অস্বস্তিতে। কক্ষে পৌঁছেও শান্তি নেই। একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে। এভাবেই হাজারো প্রতিকূলতা সয়ে মেয়েরা দেশকে এনে দেন একের পর এক সাফল্য। বাফুফের নেতৃত্বে এসেছে পরিবর্তন। এখন প্রশ্ন, এবার কি বদলাবে সাবিনাদের ঠিকানা,ভাগ্যও এবার ফিরবে তাদের?

গত সোমবার (০৪ নভেম্বর) বিকেলে কথা হয় দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সঙ্গে। কেমন আছেন? জানতে চাইলেই বললেন, ‘ভালো আছি। তবে একজনের দেখা পাওয়ার অপেক্ষা করছি।’ কে তিনি? সাবিনার সাফ জবাব, ‘যার দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে আছি, আমাদের নতুন সভাপতি স্যার। তার কাছে অনেক কিছু বলার,অনেক কিছু চাওয়ার আছে আমাদের।’

এমন সাফল্যের পর তো দাবিদাওয়া থাকবেই। তবে যৌক্তিক দাবিগুলোর তালিকা করতে গেলে দিস্তা দিস্তা কাগজ লেগে যাবে। সাবিনা সব খোলাসা করলেন না। না পাওয়ার কথাগুলো বলতে বলতে যে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছেন সাবিনারা, হালও ছেড়ে দিয়েছেন তাই। তবে একটু খোঁজ নিতেই বের হয়ে আসে ক্যাম্পে তাদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা।

প্রথমত মতিঝিলের অফিস পাড়ার দাপ্তরিক ভবনে আবাসিক ক্যাম্প হতেই পারে না। তারপরও সেটা না হয় মানা গেল। লিফটবিহীন ভবনে মেয়েদের ক্যাম্প আর বাফুফে সচিবালয়ের জন্য একটি মাত্র সিঁড়ি হওয়ায় ভোগান্তি দুপক্ষেরই। চলাচলের সময় মেয়েদের যেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হয়,নারীদের আবাসিক ক্যাম্প হওয়ায় বাফুফের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা কাজে আসা লোকজনেরও থাকতে হয় অস্বস্তিতে।

দ্বিতীয়ত আবাসিক ক্যাম্পে কক্ষ চাহিদার চেয়ে অনেক কম। মোট ১৩টি কক্ষের দুটি বরাদ্দ কোচিং স্টাফদের জন্য। বাকি ১১টিতে থাকেন ফুটবলাররা। ছয় থেকে আটজন করে ফুটবলার থাকেন একেকটি কক্ষে। সুবাদে একটি বাথরুম ব্যবহার করতে হয় ছয় থেকে আটজনকে। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

সেই কক্ষ এবং বাথরুম আবার নিয়ম করে নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হয়। দুজন বলবয় আছেন, যারা সামনের করিডোর ও বারান্দা পরিষ্কার করেন নিয়মিত। কক্ষ পরিষ্কার করার জন্য নেই কোনো ক্লিনার। এমনকি ফুটবলারদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হয়। নেই কোনো লন্ড্রি সার্ভিস। বছরব্যাপী চলা এই আবাসিক ক্যাম্পে বেশিরভাগ সময় সিনিয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের থাকতে হয়। সর্বোচ্চ ৭০ জন ফুটবলারকে এই ১১টি কক্ষে থাকতে হয়েছে। ভেবে দেখুন অবস্থা!

তৃতীয়ত সরষে ইলিশ নামে একটি খাবারের হোটেল থেকে নিয়মিত খাবার আসে ক্যাম্পের ফুটবলারদের জন্য। চারবেলা দেওয়া হয় খাবার। সাবেক ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি থাকাবস্থায় খাদ্য তালিকা কিছুটা উন্নতি করা হয়েছিল। তবে ক্যাম্পে কোনো খাদ্য বিশেষজ্ঞ না থাকায় এখন অবস্থা ভীষণ সঙ্গীন। প্রায় প্রতিদিনই পাতে থাকে চাষের রুই অথবা পাবদা। আগে মাঝেমধ্যে ইলিশ,চিংড়ির মতো মাছ জুটত। এখন সেসব থাকে না বললেই চলে। মেয়েদের শক্তিবর্ধক কোনো পানীয় দেওয়া হয় না নিয়ম করে। প্রতিদিন গদবাধা খাবার খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে কখনো কখনো মেয়েরা নিজেরাই বাজার করে এনে সেখানে পছন্দের পদ রান্না করে খান।

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আছে চোটঝুঁকিও। ক্যাম্পে অবস্থানরত ফুটবলারদের জন্য এত বছরেও স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করেনি বাফুফে। ফলে বড় ধরনের চোটে পড়লে অনেক মেয়েরই ক্যারিয়ার অকালে শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে সেই ফুটবলারের চিকিৎসার দায়িত্বও নেয় না বাফুফে। বছরে গড়ে ৫০ জন ফুটবলারের জন্য আছেন একজন মাত্র ফিজিও। নারী ফুটবলারদের সারা বছরে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকে দুটি মাঠ কমলাপুর স্টেডিয়াম ও ভবনসংলগ্ন অ্যাস্ট্রো টার্ফ। দুটি মাঠেরই টার্ফের অবস্থা অথৈবচ। এতকিছুর পরও মাসিক বেতনটা মেলে না ঠিকঠাক। এখনো তাদের বেতন-বকেয়া পাক্কা দুই মাস।

এতকিছুর পরও অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস সঙ্গী করে সংগ্রামী নারী ফুটবলাররা দেশকে বারবার এনে দিচ্ছেন সম্মান। তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে বাফুফের নতুন কমিটির জন্য শুরুতেই চ্যালেঞ্জ মেয়েদের ভাগ্য ফেরানো।

সর্বশেষ খবর

ভিডিও সংবাদ

Play Video