গুম-সংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে সরকার গঠিত কমিশনে দেড় মাসে জমা পড়েছে এক হাজার ছয়শর বেশি অভিযোগ। এর মধ্যে ৩৮৩টি অভিযোগ যাচাই করেছে কমিশন, যার মধ্যে ১৭২টি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জানান, যাচাই করা অভিযোগের মধ্যে ৩৭টি ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বিরুদ্ধে, ৫৫টি ডিবির বিরুদ্ধে, ২৬টি ডিজিএফআইর বিরুদ্ধে, ২৫টি পুলিশের বিরুদ্ধে এবং ৬৮টি অন্যান্য। তদন্ত কমিশন ঢাকা ও আশপাশে আটটি গোপন আটক কেন্দ্রের খোঁজ পেয়েছে।
বিচারপতি মইনুল বলেন, ‘অভিযোগ তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ডাকতে সমন জারি হচ্ছে। আপাতত সাতজনকে ডাকা হয়েছে, যারা সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ডিজিএফআই সদস্য।’ অভিযোগ বিষয়ে কমিশন ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এসব বাহিনীর আটটি গোপন বন্দিশালা পাওয়া গেছে, যেখানে বছরের পর বছর গুম হওয়া ব্যক্তিদের রেখে নির্যাতন করা হতো।’
কমিশনপ্রধান বলেন, ‘২০১৬ সালের দিকে গ্রেপ্তারের সময় কী কী করতে হবে– সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ধারণা করা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এসেছে।’ ভুক্তভোগীরা কেন গুমের শিকার হন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে যাদের অ্যাপারেন্টলি পলিটিক্যাল আইডেনটিটি ছিল না। কিছু আছে সরকারের সমালোচনা করেছে বিভিন্ন মিডিয়াতে। আবার সেনাবাহিনীর যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের কেন করা হয়েছে তা বোঝা গেল না। যেমন কর্নেল হাসিনকে দুইবার গুম করা হয়। একবার করা হয় তিনি চাকরিরত অবস্থায়, আরেকবার রিটায়ারমেন্টের পর। কী কারণে ওনাকে করল, ওটা বোঝা বড় মুশকিল। তবে ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে গুম করা হয়েছে– এমন অভিযোগ এখনও পাইনি।’
এই মুহূর্তে কতজন গুম আছে, তা বলা মুশকিল উল্লেখ করে বিচারপতি মইনুল বলেন, ‘এমনও ঘটনা আছে, কে নিয়ে গেল– সেটা চিহ্নিত করা যায়নি। যেসব গোপন বন্দিশালায় রেখে নির্যাতন করা হতো, সেগুলো ভেঙে আলামত নষ্ট করা হয়েছে। তবে যারা আলামত নষ্ট করছেন, তাদের গুমের সঙ্গে জড়িতদের সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। আলামত ধ্বংস না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।’
কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী নূর খান র্যাবের একটি আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বন্দিশালাতে আমরা দেখেছি, কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে রাখা হয়েছে। এমনও ঘটনা আছে, সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট ঘরের মধ্যেই বন্দির প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা। এর মধ্যেই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাখা হতো। ওই ঘরগুলো ছিল বদ্ধ। সেখানে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ ছিল না। শুধু ছোট একটা ছিদ্র ছিল, যেটা সবসময় বন্ধ রাখা হতো। কখনও কখনও বন্দিকে দেখার জন্য সেটা খোলা হতো। ড্রেনেজ সিস্টেম ছিল, ওখানেই বন্দিকে প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল করতে হতো।
তিনি বলেন, একজন মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে– এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমরা শুনেছি, আয়নাঘরের চেয়েও নিকৃষ্টতম সেল আমাদের কাছাকাছি জায়গাতেই ছিল। আমরা সেগুলো পরিদর্শন করেছি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে কমিশনের সভাপতি বলেন, পরিদর্শন করা বন্দিশালার মধ্যে রয়েছে ডিজিএফআই, উত্তরা র্যাব-১, র্যাব সদরদপ্তর, নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১, মোহাম্মদপুরের র্যাব-২, আগারগাঁওয়ে র্যাব-২ এর ক্রাইম প্রিভেনশন সেন্টার ও ডিবি কার্যালয়।
গুমের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কিনা– জানতে চাইলে কমিশনের সভাপতি জানান, বিষয়গুলো তারা খতিয়ে দেখছেন।
বিচারপতি মইনুল বলেন, গুমের শিকার অনেক ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। অনেকের খবর পরিবারও জানে না, আমরাও পাইনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫৩ বছর আগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আপনারা জানেন, বিচারকরা রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার ট্রাস্টি। অনুরূপভাবে মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সার্বভৌম নির্বাহী ক্ষমতার ট্রাস্টি। সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার ট্রাস্টি। এই তিন শ্রেণির মানুষ যদি ট্রাস্টি হিসেবে সুচারুরূপে কাজ করতেন, তাহলে দেশের চেহারা বদলে যেত। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা হয়নি। এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, রাজনীতি কে পরিশুদ্ধ করবে? রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। কেবল সৎ, নির্লোভ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমী এবং দক্ষ রাজনীতিবিদরা রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে পারেন।’
কমিশনের সভাপতি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে জাতীয় স্বার্থ বা জনস্বার্থের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে আয়নাঘরের সৃষ্টি। আয়নাঘর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। তবে র্যাব-১ এ এটাকে বলে টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল, ডিজিএফআইয়ে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল। বিভিন্ন বাহিনীর অধীনে বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু সিক্রেট ডিটেনশন সেন্টার আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুলের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ‘আয়নাঘর’ বা গোপন বন্দিশালা থেকে তিনজনের মুক্তির খবর পাওয়া গেছে। কমিশন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের ঘটনা বিবেচনায় নেবে।