ঝালকাঠি শহরের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ রোনালস রোডে ভিআইপি বাড়ি। ছিলো নিছিদ্র নিরাপত্তা। ভিতরেও ছিলো রাত্রিকালীন পাহাড়ার ব্যবস্থা।ওই ভবনের মালিক রাজনৈতিক একজন সিনিয়র জাতীয় নেতা। যখন এলাকায় আসতেন তখন মানুষ থৈ থৈ করতো ভবনটিতে। ভবনের সামনে থাকতো তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন গাড়ির সারি। দীর্ঘ জ্যাম লেগে থাকতো বাড়ির সামনের সড়কটিতে। যান চলাচল ব্যহত হতো, পথচারীরা, গাড়ি ও মানুষের ভীড়ে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারতো না। কিন্তু সেই বাড়িটিতে এখন শুনসান নিরবতা। অগ্নিকান্ডে পুড়ে ক্ষতবিক্ষত ভবনটি দেখলে এখন মনে হচ্ছে পোড়া কোন ভূতুরে বাড়ি। ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসনের সাবেক এমপি, সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামীলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, ১৪দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু’র বাড়ি এটি। সুদৃশ্য বাড়ির ভবন দুটির ভেতরের পুরো অংশ প্রায় পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ভবনটির দরজা- জানালাও নেই।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারে শোচনীয় ক্ষমতাচ্যুতির পরেই দুপুরে ঝালকাঠি-২ (ঝালকাঠি সদর- নলছিটি) আসনের সংসদ আমির হোসেন আমু’র বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুদ্ধরা। ওই একই দিন আমু’র অনুসারী জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ও ঝালকাঠি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমানের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করে ক্ষুব্দ জনতা। এ সময় ভবনে থাকা সকল মালামাল লুট ও অগ্নি সংযোগ করে ওই চক্রটি। সেই সাথে জেলা- উপজেলা আওয়ামীলীগের ক্ষমতার দাপট দেখানো প্রভাবশালী নেতা, সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর হাফিজ আল মাহমুদের ২ টি বিল্ডিংয়ের একটিতে ভাংচুর করে আগুন দেয় ও অন্যটি ভাংচুর করে। জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও পৌর কাউন্সিলর কামাল শরীফের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও লুটপাট করে সুযোগসন্ধানীরা। এ ছাড়া অনেক নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গোডাউন ও অফিসে লুটপাট এবং পরে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত দোর্দন্ড প্রতাপে ঝালকাঠি শাসন করা এই আওয়ামী লীগ নেতা আমু’র বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানে না কেউ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝালকাঠি উপজেলা সদরের ওই সব বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পুরো বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান পুড়ে কিছু ছাই পড়ে আছে। আর ওই সব ভবন কালো হয়ে রয়েছে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের প্রাণকেন্দ্র ফায়ার সার্ভিসের মোড় থেকে রোনালসে রোড সংলগ্ন সাংসদ আমির হোসেন আমুর বাস ভবন থেকে শুরু করে রীড রোডে (পুরাতন টাউনহল) থাকা আওয়ামীলীগের অফিসে হামলা করে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করে বিক্ষুদ্ধ জনতা। এরপরই তারা উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে দু’দফা হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। এমন কি তারা শহরের আওয়ামীলীগ নেতাদের বিভিন্ন গোডাউন এবং অফিসে হামলা ও লুটপাট করে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী রিক্সা চালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই লুটপাটের সময় স্থানীয় বিএনপি ও অংগ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাদের বিজয় আনন্দের মিছিলে থাকলেও অপরিচিত সুযোগন্ধানী লোকজন এমন কাজ করেছে। স্থানীয় আওয়ামীলীগের একাধিক নেতারা বলেন, এমনদিন দেখতে হবে ভাবিনি। বিষয়টা অত্যন্ত লজ্জার। ঝালকাঠি সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন,‘যত ধরনের ঠিকাদারি টেন্ডার, সব ক্ষেত্রেই আমু’কে দিতে হতো নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা। ঠিকাদার নির্বাচন প্রশ্নেও তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পরও নানা কৌশলে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কথা না শুনলে কেবল বদলি নয়, শারীরিক মানসিকভাবেও হতে হতো হেনস্তা।’ সড়ক বিভাগের মতো এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর, গণপূর্ত, থানা প্রকৌশলী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল একই অবস্থা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঠিকাদার আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, যে কোন কাজ পাওয়ার আগে আমু’র ভায়রা কিরণ ও তার শালিকা মেরী ও পরীকে দিতো হতো পার্সেনটেজ। কম দিলেই কাজ অন্য কোন নেতা বা ঠিকাদারকে দিয়ে দিতো। লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের পরে সংসদ সদস্য (এমপি) আমির হোসেন আমুর বাসভবন থেকে বিদেশি মুদ্রাসহ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। ৫আগস্ট দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঝালকাঠি শহরের রোনালস রোডে আমুর বাসা থেকে এই অর্থ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দুপুরে বিক্ষুদ্ধ লোকজন আমুর বাসভবনে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময়ে যা পারছে হাতিয়ে নিছে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কয়েক দফা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর রাত ১২টার দিকে স্থানীয়রা ওই ভবনের তিনতলায় আবারও আগুন জ্বলতে দেখে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভানোর সময় কয়েকটি পোড়া লাগেজ থেকে টাকার বান্ডিল বেড়িয়ে আসে। এরপর তারা বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা টাকার লাগেজগুলো উদ্ধার করেন। তারা একটি লাগেজে অক্ষত এক কোটি টাকা এবং অপর লাগেজগুলো থেকে গণনা করে আংশিক পোড়া দুই কোটি ৭৭ লাখ টাকা উদ্ধার করেন। এ ছাড়া বিদেশী ডলার ও ইউরোসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের মুদ্রা রয়েছে উদ্ধারকৃত অর্থের মধ্যে।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ভবনটির তৃতীয় তলার কক্ষে অনেকগুলো কম্বলে লাগা আগুন নেভানোর সময় কিছু টাকার বান্ডিল বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে কয়েকটি লাগেজও পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়। টাকাগুলো প্রশাসন জব্দ করে এবং সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করে রাখা হয়। সেই জমকালো বাড়িটি এখন শুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। পোড়া বাড়িটিতে কেউ প্রবেশও করছে না। এ যেন পোড়া এক ভুতুরে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।