মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় এবার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশ্ব পরিস্থিতি। কারণ ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর একক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যৎ স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সম্পর্কের নতুন মেরূকরণ তৈরি হয়। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নজিরবিহীন অবরোধ আরোপ করে চীন, ভারত ও সৌদির সহায়তায় সেটি তেমন কাজ করেনি। বরং এই যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়াই আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়েছে।
অন্যদিকে গত বছর অক্টোবরে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ বিশ্ব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে এবং সামরিক শক্তিধর দেশগুলোকে বড় পরীক্ষায় ফেলে দেয়। একদিকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি, অন্যদিকে ইসরায়েলের গণহত্যা ও পশ্চিমা শক্তির সমর্থন বিশ্ব জনমত তাদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে। এই যুদ্ধ শুধু গাজায় সীমাবদ্ধ থাকেনি এক বছরের মাথায় তা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ লেবানন, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেনে ছড়িয়ে পড়ে।
এই অশান্ত বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন নির্বাচন শুধু তাদের জন্য নয়, বিশ্ব রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ মার্কিন জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে যিনি ধারণ করবেন তিনিই হবেন আগামী দিনের মার্কিন কান্ডারি এবং তাঁর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির স্থিতিশীলতা।
নির্বাচনে মোট ছয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মিডিয়াতে প্রধানত দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর কথাই আসছে। ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়াও যাঁরা নির্বাচন করছেন তারা হলেন গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন, লিবার্টিয়ানের চিজ অলিভার, সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড লিবারেশনের ক্লাউডিয়া দে লে ক্রুজ, কনস্টিটিউশনের র্যান্ডেল টেরি ও স্বতন্ত্র থেকে কর্নেল ওয়েস্ট। এই ছয়জনের দুজন প্রার্থী বাম ঘরানার। কমলা-ট্রাম্পের বাইরে গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন উল্লেখযোগ্য ভোট টানবেন বলে মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে তাঁর ভোটপ্রাপ্তি ট্রাম্পের বিপরীতে কমলার বিজয়কে কঠিন করে তুলতে পারে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ট্রাম্প ও কমলার নীতি অনেকটাই বিপরীতিমুখী। যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস বর্তমান মার্কিননীতি অনুযায়ী ইউক্রেনকে সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। এছাড়া দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা, অবৈধ অভিবাসীদের আইনি প্রক্রিয়ায় স্থায়ীকরণ, বর্ণবাদ নির্মূলকরণ, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে করারোপ, পরিবেশ বিষয়ে বাইডেনের নীতির অনুসরণ ইত্যাদি।
অন্যদিকে ট্রাম্প বলছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ইউক্রেনে সহযোগিতা ও যুদ্ধ বন্ধ করবেন, মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করবেন, শ্বেতাঙ্গবাদের পক্ষে থাকবেন, অবৈধ অভিবাসীদের আটক ও বহিষ্কার করবেন। অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে ৪৫০ মাইল দেয়াল তৈরি ও স্থায়ী পুলিশ-সেনাবাহিনী গঠনের কথা বলছেন। বিদেশি পণ্য আমদানিতে কর বৃদ্ধি, নাগরিক কর কমানোর কথা বলেছেন। পরিবেশ নিয়ে তিনি বাইডেনের বিপরীতে হাঁটবেন।
এদিকে মার্কিন নির্বাচনের ঠিক আগে রাশিয়ার কাজানে ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনটি ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর প্রথম কোনো বৃহৎ আন্তর্জাতিক আয়োজন। সম্মেলনটির মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমাদের দেখাতে চেয়েছেন যে তারা কতটা ব্যর্থ। সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং তাঁকে ইউক্রেনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে গুতেরেস জেলেনস্কির শত্রু পুতিনের দেশে যাওয়াতে যদি তাঁকে ইউক্রেনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় তাহলে তিনি নিজে রাশিয়ার মিত্র চীন-ভারতের নেতাদের সঙ্গে তাদের দেশে গিয়ে বৈঠক করেছেন কোন যুক্তিতে?
ওদিকে, মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কি খুব একটা স্বস্তিতে নেই। কেননা ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতি দেশটিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এদিকে রাশিয়ার মাটিতে চীন-ভারতের বিশেষ আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৈঠক ও চুক্তি এশিয়ার ভূ-রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। কানাডার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ও চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মধ্যে তাদের এই বোঝাপড়া পশ্চিমা শক্তির জন্য একটি নতুন বার্তা ইঙ্গিত করে।
প্রশ্ন হচ্ছে এ পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে কে জিতবেন? ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা না রিপাবলিকান ট্রাম্প? প্রতিদিনই মার্কিন বিভিন্ন সংস্থা-মিডিয়াতে এ নিয়ে চুলচেরা জরিপ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব জরিপের ফলাফল স্পষ্টত কারও বিজয় নিশ্চিত করে না। বিশেষত ওয়াশিংটন পোস্ট তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জরিপগুলো সংকলন করে দেখিয়েছে যে, কখনও কমলা, কখনও ট্রাম্প সামান্য এগিয়ে থাকেন। তবে মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতি যেহেতু সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় না, হয় ইলেকটোরাল ভোটের মাধ্যমে। সে কারণে কেউ অধিক ভোট পেলেও হেরে জেতে পারেন এমন নজির আছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৭টি বড় অঙ্গরাজ্য ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
তবে সামাগ্রিক বাস্তবতায় আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পই নির্বাচিত হবেন। আমেরিকার জনগণ উদার হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা রক্ষণশীলতার পরিচয় দিতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের বিপরীতে তারা নারী প্রার্থী কমলাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নাও নিতে পারেন। কেননা ২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ত্রিশ লাখ ভোট বেশি পেয়েও জিততে পারেননি, ইলেকটোরাল ভোটে হেরে গেছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে বিভক্ত করছেন সময়ই বলবে এর ফলাফল কি হবে?
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক