বাড়ির উঠান কিংবা রাস্তার পাশে পতিত জমিতে বস্তায় আদা চাষ করে অনেক কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাংলাদেশকে। একদিকে উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে আদার আমদানি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৬ হাজার টন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৪১ হাজার টন আদা আমদানি করা হয়। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯১ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ গত অর্থবছরে আদার আমদানি বেশ খানিকটা কমেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাগিং বা বস্তায় আদা চাষ উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, চাষযোগ্য পতিত জমি বা বসতবাড়ির আশপাশে, ফলবাগান ও বিল্ডিংয়ের ছাদে জিও ব্যাগে আদা চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি ব্যয় কমানো সম্ভব। জিও ব্যাগে আদা চাষ করে অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। জিও ব্যাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য, পরিবেশবান্ধব, তাপ প্রতিরোধী, জলরোধী এবং ব্যবহারের জন্য টেকসই। এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে কন্দ পচা রোগ হয় না। যদি রোগ দেখা যায় তখন গাছসহ বস্তা সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে কন্দ পচা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম।
মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষক প্রশিক্ষণ, বস্তা পদ্ধতিতে আমবাগান-লিচুবাগানসহ পতিত জমিতে প্রদর্শনী স্থাপন, সারাদেশে লিফলেট বিতরণ, উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমের পাশাপাশি মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ফলে বস্তায় আদা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
রংপুরের পীরগঞ্জের চতরা এলাকার ব্যবসায়ী সোহেল প্রধান। ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকলেও কৃষিতে তাঁর অদম্য আগ্রহ। তাঁর নিজ গ্রাম ছোটকুয়ায় ২০ বিঘা জমিতে মাছ চাষের জন্য দুটি পুকুর করেছেন। সেই পুকুরের চারপাশে আম, জাম, কাঁঠালসহ নানা প্রজাতির গাছপালা শোভা বাড়িয়েছে। বিকেল হলে সেখানে তৈরি হয় এক নৈসর্গিক পরিবেশ। বাড়তি লাভের আশায় পুকুরের চারপাশে তিনি এবার আদা চাষ করেছেন।
সোহেল প্রধান বলেন, ‘আমি আগে কখনও বস্তায় আদা চাষ করিনি। এবার ১ হাজার ৮০০ বস্তায় চাষ করছি। পুকুরপাড়ে গাছের নিচে পতিত জায়গা থাকার ফলে চাষ করতে তেমন কোনো ঝক্কি পোহাতে হয়নি।’ উপজেলা কৃষি অফিসের সার্বিক পরামর্শে নিয়মিত আদা গাছ পরিচর্যা করে আসছেন তিনি। তাঁর আশা, এতে তিনি লাভবান হবেন।
জামালপুরের নুর ইসলাম বাড়ির পাশে আমবাগানে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ব্যাগিং পদ্ধতিতে বস্তায় মাটি ভরাট করে আদা লাগিয়েছেন। মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষি অফিসের মাধ্যমে পরামর্শ নিয়ে চাষ শুরু করেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি তিনি বস্তায় আদা চাষ করে এলাকায় প্রশংসিত হয়েছেন। আশা করছেন ভালো লাভের। তাঁর দেখাদেখি ব্যাগিং পদ্ধতিতে আদা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন এলাকার অনেকেই।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বস্তায় আদা চাষ করলে বাড়তি ফসলি জমি ও শ্রমের প্রয়োজন হয় না। বস্তার মাটি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। মাটির সঙ্গে গোবর সার, খৈল, ছাইসহ রাসায়নিক সার মিশিয়ে কৃষকরা পতিত জমি কাজে লাগিয়ে বস্তায় আদা চাষ করছেন। সার-গোবর ছাড়া একটু খেয়াল রাখলে ও মাঝে মাঝে পানি দিলেই আদা গাছ টিকে যাবে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদার আমদানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ দেশে উৎপাদন বেড়েছে। কিছু নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে। এসব প্রযুক্তি এখন মাঠ পর্যায়ে ধারণ করা হয়েছে। যেমন– ব্যাগে করে আদা চাষ। এটা এখন গ্রামীণ কৃষিতে ব্যাপক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা খারাপ জমিতে এমনকি বাড়ির আঙিনায় করা যায়। আগামী কয়েক বছর যদি এভাবে উৎপাদন বাড়ে, তবে আমরা আদায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব। এতে ডলার সাশ্রয়ও হবে।
কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ইতোমধ্যে বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আগামীতে দেশ আদা চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে কৃষক সহজেই লাভবান হওয়ার সুযোগ পান। কারণ বাড়ির আশপাশে পতিত জমি, আমবাগান ও বাসার ছাদে সহজেই আদা চাষ করা যায়। এই আদা চাষ পদ্ধতি আগামীতে কৃষিতে বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে যাচ্ছে।