আজ- বুধবার | ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৫০
১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাগ বসানো মেয়ে….

 

আমি যে কলেজে পড়তাম, সেটা ছিল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেদিন ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের মহড়া চলছিল, মহড়া দেখতে আমার মতো আর অনেকে হাজির। অডিটরিয়ামে কি একটা সেমিনার চলছিল, তাই বাণিজ্য ভবনের ছোট্ট ক্লাসটায় মহড়া হচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমিই শেষে আসলাম পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার পিছু পিছু আরও একটি মেয়ে এল, বসার জায়গা নেই, আমি ছোট্ট একটা ধুলামাখা বেঞ্চ পেলাম ঝেড়ে বসে পড়লাম।

মেয়েটি বসার কোনো জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমি কি বলব পাশে বসতে? আবার কি–না–কি মনে করে? ভাবতে লাগলাম, অবশেষে বললাম—এই যে আপনি চাইলে আমার পাশে বসতে পারেন, আমার বলতে দেরি হলেও মেয়েটির বসতে দেরি হলো না, একটা ধন্যবাদ দিল না। মহড়া দেখার পাশাপাশি আড়চোখে আমাকে ও দেখছিল, আমি যে দেখছিলাম না তা না, তাই তো কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেল। আমার সিটে ভাগ বসিয়ে পুরো মহড়াটাই দেখল অথচ আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না।

রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, এসময় টাতে রিকশা পাওয়া অনেক কষ্টকর। অবশেষে একজন রিকশাওয়ালাকে আসতে দেখে আমি ডাক দিয়ে থামতে বললাম, পেছন থেকে আরও কে একজন তাকে থামতে বলল, ফিরে দেখি সেই মেয়েটি।

যেহেতু আমি আগে ডেকেছি, তাই আমি পেলাম রিকশাটি, মেয়েটি হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। হতাশ হওয়ারই কথা এ সময় টাতে রিকশা পেতে বহু হিমশিম খেতে হবে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে বসল,

সজীব ভাইয়া, আমাকে কি নেওয়া যাবে সঙ্গে? আমি তো থ বনে গেলাম তার মুখে আমার নাম শুনে,

আপনি আমাকে চিনেন?

না চেনার কী আছে? আপনাদের বাসার তিন তলায় তো থাকি আমরা, নতুন এসেছি, আপনি চিনবেন কীভাবে, সারাদিন তো বই নিয়ে রুমেই পড়ে থাকেন।

আচ্ছা বসেন, আমি তাকে আমার পাশে বসার জন্য ভাগ দিয়ে দিলাম। বাসায় পৌঁছলাম দুজনে।

সুমির কথা বলছি, সে ক্লাস নাইনে পড়ে মাত্র, আমাদের বাসায় এসেছে গত মাসে। আগে আশপাশে কোথায় যেন থাকত।

আমি ছোটবেলা থেকেই ঘরকুনো, আমার রুমটা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মনে হয়, বেশির ভাগ সময় আমার খাবার আম্মু রুমে নিয়ে আসে। তাই নতুন ভাড়াটিয়া কে এল, কে গেল আমি জানিও না।

এর পর থেকে প্রায় আমার সঙ্গে আসা কিংবা যাওয়া হয়ে যেত কলেজে। আমাদের বাসায় ও আসা বেড়ে গেছে সুমির, আম্মুকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করত, আম্মু ও ওর ভক্ত হয়ে গেছে দেখলাম।

শীতকালে চিতই পিঠাটা আমার খুব প্রিয়, তবে দুইটার বেশি খেতে পারি না। সেদিন আমার রুমে আম্মু নাশতা রেখে গেল, দেখি একটা মাত্র পিঠা, মাকে বললাম একটা কেন? মা বললেন, দুইটাই রেখেছিলাম, একটা সুমি এসে খেয়ে ফেলেছে।

দেখেন তো কেমন লাগে? শেষ পর্যন্ত দেখি এই মেয়ে আমার খাবারেও ভাগ বসাতে শুরু করেছে।

সবচেয়ে অবাক হলাম, যখন শুনলাম আমার রুমে এসে আমার অনুপস্থিতে আমার ল্যাপটপ, বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে…

এইচএসসি পরীক্ষার পর আমার সেনাবাহিনী তে চান্স মিলে গেল, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি তে চলে গেলাম ট্রেনিংয়ে, মা আমার একা হয়ে গেলেন, সুমি হয়ে উঠল আম্মুর একমাত্র বন্ধু, সহযোগী সব কিছু।

ট্রেনিং এ থাকাকালীন একদিন ফোন করলাম, সুমিই ধরল ফোনটা।

আন্টির শরীর খারাপ, তাই আমি রান্নাটা করে দিচ্ছি, আংকেল এখনো আসেনি বাসায়।

সুমি, আমার মায়ের দিকে একটু খেয়াল রেখ।

আবার আমাকে খোঁচা দিবেন না তো, আপনার মায়ের ওপর ভাগ বসাচ্ছি বলে?

না, দেব না।

মায়ের সঙ্গে কথা হলেই শুধু সুমির কথা বলে, আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সুমি ঠিকই আমার মায়ের ভাগটাও নিয়ে নিয়েছে।

এই তো বছর দুয়েক আগের কথা, আমার পোস্টিং তখন রাঙামাটি। হঠাৎ খবর এল আম্মু অসুস্থ। সিও থেকে ছুটি মেলার পর আমি ছুটে চললাম বাড়ির দিকে, একদম বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া লাগেনি, আম্মুকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট্ট একটা অপারেশন করা হয়েছে। আমি জানতাম না, আমাকে জানানো হয়নি।

রক্তক্ষরণ হয়েছে আম্মুর, রক্তও দেওয়া হয়েছে। সুমি নাকি আম্মুর জন্য রক্ত দিয়েছে। সুমির প্রতি কেন জানি মাথানত হয়ে আসতে থাকে আমার। আমাদের কেউ না অথচ সব কিছুতেই আছে। এত দিন ভাবতাম শুধু ভাগ নিয়ে যাচ্ছে, আজ দেখলাম মেয়েটি ভাগ দিতেও জানে। আমার আম্মুর শরীরের রক্তেও এখন তার ভাগ আছে।

আম্মুর অপারেশন পর একদম দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কাজকর্ম তো দূরে থাক, তাঁকে দেখতেও একজন লাগে, সুমির এইচএসসি পরীক্ষা শেষ, তাই তার অবসর থাকায় সে ই দেখছে আম্মুকে।

আমার বিয়েটা একদম জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, মেয়ে দেখা হচ্ছে, আম্মুর কাছে ঘুরেফিরে সুমির কথায় শুনছি, শেষ পর্যন্ত আমার সব কিছুতেই ভাগ বসানো মেয়েটিকেই ঠিক করা হলো আমার জীবনের ভাগ বসানোর জন্য।

বাসর রাতে সুমিকে বলা আমার প্রথম কথা কি ছিল, জানেন?

‘মেয়ে, শেষ পর্যন্ত তুমি আমার জীবনেও ভাগ বসালে?’ তবে একটা জিনিসে শুধু তুমি কেন, কেউই ভাগ বসাতে পারবে না, সেটা হচ্ছে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। সুমি ঘোমটাটা একটু সরিয়ে বলল- ‘আমারও’।

আমাদের দুজনের ভালোবাসাবাসি চলতেই থাকে। আমার আম্মুও এত দিনের বন্ধু, সহযোগীকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে খুব খুশি। সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করেই আমাদের সংসার চলছে।

জানেন? এ মুহূর্তে অনেক খুশি লাগছে আমার। একটু আগে সুমি ফোন করে জানাল আমাদের দুজনের ভালোবাসায় ভাগ বসাতে একজন অতিথি আসতে যাচ্ছে। রেশমা আন্টি, আম্মুর খালাতো বোন, গাইনি ডাক্তার, একটু আগে আম্মু আর সুমি তার চেম্বার থেকে এল। এসেই আমাকে ফোনটা করল।

*লেখক: জাহেদুল আলম, সৌদি জার্মান হসপিটাল, শারজাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সর্বশেষ খবর

ভিডিও সংবাদ

Play Video

এইরকম আরো খবর