আজ- বুধবার | ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:৫৪
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিঃসঙ্গতার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণ

জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কবি। যার কবিতায় প্রকৃতি, নির্জনতা ও অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারা একসূত্রে গাঁথা। ১৯৫৪ সালে আজকের এই দিনে ট্রাম দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা কবিতার আকাশে এক চিরস্থায়ী আলোকরশ্মি হয়ে রয়ে গেছে। জীবনানন্দ কাব্যভাষায় যেমন গভীরতা এনেছেন, তেমনি নির্মাণ করেছেন একান্তে বসে দেখা প্রকৃতির এক নিভৃত অনুভূতি।

এ কবির জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু মনোনিবেশ করেন কবিতা রচনায়। তিনি যখন লিখতে শুরু করেন, তখনকার বাংলা কবিতা মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়াতলে বেড়ে উঠছিল। তবে জীবনানন্দ নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন, যা তাঁকে স্বতন্ত্র কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) জীবনানন্দের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ, যেখানে তাঁর কবিতার নির্জনতা, নিস্তব্ধতা ও আত্মজিজ্ঞাসা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন এবং বাংলার গ্রামীণ দৃশ্যপট তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয়। পরে ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) গ্রন্থে তিনি বাংলার প্রকৃতিকে এমনভাবে চিত্রিত করেন, যা বাঙালি পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এ গ্রন্থে কবি বাংলার সৌন্দর্যকে এক অসীম রূপে তুলে ধরেছেন, যা আজও পাঠকের মনকে আন্দোলিত করে।

জীবনানন্দ দাশের অনন্য কাব্যভাষা এবং প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে ‘বনলতা সেন’ কবিতায়। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত এ কবিতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এখানে বনলতা সেনকে শুধু একজন নারী চরিত্র নয়, বরং বাংলার প্রকৃতি ও জীবনের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর কবিতা শূন্যতার মধ্য থেকেও মানুষের ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা এবং নির্জনতার মধ্যেও প্রকৃতির প্রতি টান– এই দ্বৈততা জীবনের এক গভীর সত্যের সন্ধান দেয়।

জীবনানন্দের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে মৃত্যুচেতনা। সাহিত্যকর্মে মৃত্যুকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বারবার এমন এক জগৎ নির্মাণ করেছেন, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষ তাঁর অস্তিত্বের অর্থ খোঁজে। তাঁর অনবদ্য লেখনীতে প্রকৃতি যেন মানব অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর রহস্যময়তা সমানভাবে উদ্ভাসিত। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দ দাশের এ অস্তিত্ববাদী চেতনা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

এ কবির কবিতায় প্রকৃতির গভীরতা ও নৈঃশব্দ্য যেমন পাঠকের মনকে স্পর্শ করে, তেমনি মানবজীবনের অন্তর্নিহিত সংকট এবং দ্বন্দ্বকেও প্রকাশ করে। জীবনানন্দ ছিলেন এক নীরব বিদ্রোহী, যিনি কবিতার মাধ্যমে একটি নির্জন, সুনিবিড় দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিলেন, যা তাঁর সময়ের আধুনিক কবিতার মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম আজও সমকালীন। তাঁর কবিতা নতুন প্রজন্মের পাঠক ও কবিদের জন্য এক বিশেষ প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তাঁর জীবন এবং সাহিত্য আমাদের প্রকৃতির প্রেম, নিস্তব্ধতা এবং জীবন-মৃত্যুর গভীর দার্শনিক মর্মার্থ অন্বেষণের প্রেরণা দিয়ে যায়।
জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে নিহিত সৌন্দর্য, প্রেম ও নির্জনতা যেন আমাদের প্রতিনিয়ত আত্মজিজ্ঞাসার পথে উন্মুক্ত রাখে। তাঁর কবিতার চিরকালীন প্রাসঙ্গিকতা মলিন হওয়ার নয়।

সর্বশেষ খবর

ভিডিও সংবাদ

Play Video

এইরকম আরো খবর