ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ আট কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), পাঁচজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও বাকী দুজন ব্যাংকের দুটি বিভাগের প্রধান। তারা সবাই এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
সোমবার ব্যাংকটির পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার ওই চিঠিটি ইস্যু করা ছিল।
বরখাস্তরা হলেন- অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জে কিউ এম হাবীবুল্লাহ (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এবং সাইফুল আলমের একান্ত সচিব মো. আকিজ উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংকের ঋণের দায়িত্বে থাকা মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বির, মো. রেজাউল করিম ও ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া প্রধান অর্থপাচার প্রতিরোধ কর্মকর্তা (ক্যামেলকো) তাহের আহমেদ চৌধুরী ও আইবিটিআরএ প্রিন্সিপাল মো. নজরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের এসইভিপি এএসএম রেজাউল করিম সই করা চিঠিতে বলা হয়, ‘ইসলামী ব্যাংকের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার, ব্যাংকের সব স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা, তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন ৪৭ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ অথবা প্রয়োজনে প্রাক্তন পরিচালকদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে বোর্ড পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।’ এদিকে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৬ ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো আর কোনো গ্রাহককে ঋণ সুবিধা দিতে পারবে না।
ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
এসব ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে হাজার-হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে গেছে। আর ওই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব ব্যাংক নতুন করে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। আগের ঋণ নবায়নও করতে পারবে না। তবে কৃষি, চলতি মূলধন, এসএমই, আমানতের বিপরীতে ঋণ ও প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে পারবে। পাঁচ কোটি টাকার বেশি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।
জানা গেছে, এক দশক আগেও দেশের শীর্ষ ব্যাংক ছিলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। নিয়মনীতি পরিপালন, গ্রাহককে সেবা দেওয়া ও আর্থিক সূচকে অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এই ব্যাংক। গ্রাহকের আস্থার কারণে স্থানীয় আমানত কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে এটি সবচেয়ে এগিয়ে ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ওই বছর সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ হিসেবে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের এক–তৃতীয়াংশ। এই টাকা বের করতে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। ঋণের যে তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তথ্যমতে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ যখন ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন এটিতে এস আলমের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছিলো ৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিলেন তিনি। তখন ব্যাংকের মোট ঋণ ছিলো ৬১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা আর আমানত ছিলো ৬৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। কর্মকর্তা ছিলেন ১০ হাজারের কম। নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমানত বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন নতুন শাখা খুলে পটিয়ার লোকদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। ফলে সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা এখন ৩৯৫টি। এর বাইরে রয়েছে ২৫০টি উপশাখা। ২০২৩ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা ও ঋণ ১ লাখ ৬০ হাজার ২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে বেশি টাকা ঋণ হিসেবে বের করে দিয়েছে ব্যাংকটি। বাড়তি এই টাকা এসেছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।